দি থিংকার

সত্তরের  দশকে ইংরেজি শিল্পসমালোচক জন পিটার বার্জারের তৈরী ওয়েজ ওফ সিইং ’ (Ways of Seeing) নামের বিবিসি টেলিভিশনের ধারাবাহিক অনুষ্ঠানটি (পরবর্তীতে যা বই আকারে বের হয় ) শিল্পকলাকে পযর্বেক্ষনের ক্ষেত্রে একটি যুগান্তকারী প্রক্রিয়ার পথ দেখিয়েছিল। এবং যা  শিল্পরসিকদের শিল্পকর্ম দেখার দৃষ্টিভঙ্গিতে   চিরস্হায়ী প্রভাব ফেলে। আমাদের চোখের দেখা ও জানার র্পাথক্য যে কত ব্যাপক হতে পারে তা হয়তো কিছুটা হলেও বুঝতে পেরেছিলাম, বছর কয়েক আগে, প্যারিসের আধুনিক শিল্পকলার মিউজিয়াম ‘মিউজে ডে ওরসে ’ (Musee d’Orsay) – তে গিয়ে।

সেখানে বিখ্যাত ফরাসী ভাস্কর অগুস্ত রঁদ্যা-র (( François-Auguste-René Rodin)(১২ নভেম্বর ১৮৪০ -১৭ নভেম্বর ১৯১৭ )) ‘দি গেইটস  ওফ হেল’ (The Gates of Hell)  নামক  ভাস্কর্যের উপরের দিকে ‘দি থিঙ্কার’ (The Thinker)- এর ঝুকে থাকা, শরীরটা দেখে চমকে যাই আমি। সর্বমোট ১৮০ টা  মূর্তি সহ, ৬ মিটার উচূ ও ৪ মিটার প্রস্হ ও ১ মিটার ঘন, এই ভাস্কর্যে, থিঙ্কারের ছোট্ট ফিগারটাকে এভাবে দরজার উপরে বসে নীচের দিকে ঝুকে থাকতে দেখবো ভাবিনি কখোনো হয়তো।  সাধারণত রঁদ্যার  এই ভার্স্কযটি (দি থিঙ্কার)  ফ্রি স্ট্যান্ডিং ভার্স্কয হিসেবেই বেশী পরিচিত। বিখ্যাত ও সুপরিচিত এই ভার্স্কযটিকে আধুনিক কালের অন্যতম জনপ্রিয়  ভার্স্কযের একটা বলা যায় নির্দ্বিধায়। যা জ্ঞান বা দর্শনের  রুপক  প্রতিকৃতি হিসেবে সর্বাধিকভাবে ব্যবহৃত  হয়ে আসছে বিশ্বের বিভিন্ন সংস্কৃতিতে। এই অর্থে এর সর্বজনীনতা বিশ্বব্যাপী।

শিল্পীর  সৃষ্ট সব শিল্পকর্মই কোনো না কোনো ভাবে শিল্পীর আত্মকথন যদিও; তারপরেও খতিয়ে দেখতে গেলে এর পেছনের  গল্প ও ইতিহাসও আসলে আরো অনেক  তথ্যের যোগান দেয় শিল্পীর উদ্দেশ্য, তার সৃষ্টির সৃজনশীলতার প্রেক্ষাপট সম্বন্ধে। এই গল্পের শুরু যখন, তখন  ফ্রান্সে ইম্প্রেশনিজমের জোর  হাওয়া বইছে। শিল্পীদের শিল্পচর্চার জগতে বিরাজ করছে নতুন উত্তেজনা। এই সময় ভাগ্য অন্বেষনরত এক ভাস্কর, পৌঁছে যায় দোজখের দরজার কাছে এবং সেটাই তাঁর জন্য খুলে দেয় খ্যাতির দরজা।

১৮৮০ সালে ‘দি ডেকোরেটিভ আর্ট মিউজিয়াম’ (The Decorative Art Museum)  প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা চলাকালীন, মূল  মিউজিয়ামের  প্রস্তাবিত  ভার্স্কয  খচিত  প্রধান দরজাটি তৈরী করার সুযোগ মেলে শিল্পী রঁদ্যার  ভাগ্যে। দুর্ভাগ্যজনক কিছু কারণে, প্রকল্পটি বাস্তবে রুপ না নেয়ায়, কোনোদিনও সেটা সমপন্ন করতে পারেননি রঁদ্যা। তবে পরবর্তীতে ভাস্কর  তাঁর  জীবনে এই স্হাপনা  শিল্পটির  (দি গেইটস ওফ হেল) ভুমিকা ছিল খুবই গুরুত্বপুর্ণ। কারণ   শিল্পীর জীবনের শেষ র্দীঘ  ৩৭ বছরে  সৃষ্ট, নানা শিল্পকর্মের  মুল  অনুপ্রেরণা ছিলো এটি। এবং তিনি ইএই স্হাপনা শিল্পের  ১৮০ টা ফিগারের মধ্য থেকে ধারনা নিয়ে, পৃথকভাবে ফ্রি স্ট্যাডিং ফিগার বা ভার্স্কয গড়ে তোলেন;  আর  তাদের মধ্যে দি থিংকার  অবশ্যই  অন্যতম।

‘দি থিংকার’ দেখে প্রথমেই মনে আসে গভীর চিন্তায় মগ্ন কোন ভাবুক, কিন্তু শিল্পরসিকদের  মনে স্বভাবতই  প্রশ্ন  জাগে, দার্শনিকের প্রতিকৃতিতে অলস ভঙ্গিতে বসা এই নগ্ন পুরুষটি আসলে  কে?  সে কিই বা ভাবছে নরকের  দরজায় বসে?  শিল্পকলার ইতিহাসে, বিভিন্ন সময়ে, বিভিন্ন শিল্প সমালোচকেরা  ভিন্ন ভিন্ন ধারনা পোষন করেছেন  এই ভার্স্কযটি সম্পর্কে। কেও ভেবেছেন সে স্বয়ং ঈশ্বর, মর্ত্যের সমস্ত প্রানীকুলের দুর্ভাগ্যের জন্য চিন্তাভারাক্রান্ত। কিংবা  সে নিজেই প্রথম মানব আদম ভাবছে তাঁর কৃতকর্মের জন্য বিশ্বের মানব কুলের প্রতি যে কালো আধাঁর নেমে এলো তার কথা অথবা যেনো ভাস্কর নিজেই, তাঁর সৃষ্ট শিল্পকর্মের বিন্যাস নিয়ে চিন্তিত !

640px-Paris_2010_-_Le_Penseur

তবে রঁদ্যা তার  এই ভাস্কর্যটির  মূল প্রেরণা নিয়ে স্বয়ং লিখেছিলেন:

’দি থিংকার’ এর একটি কাহিনী আছে। যখন বেশ  অনেকদিন আগে আমি ’ দি গেইটস অফ হেল’- এর পরিকল্পনা করেছিলাম, দরজার  সামনে পাথরে আসীন তাঁর কবিতার পরিকল্পনার কথা ভাবছেন,কবি দান্তেকে মনে করে; তাঁর পেছনে থাকবে ’দি ডিভাইন কমেডি’র সব চরিত্ররা। পরিকল্পনাটি বাস্তবে রুপ পায়নি; সবার থেকে আলাদা ক্ষীনকায়া,তপস্বী, দীর্ঘ রোব পরনে দান্তের  ভাস্কর্য  এখানে হয়তো কোন অর্থবহ কিছু হতো না। আমার অনুপ্রেরণার দ্বারা পরিচালিত হয়ে আমি অন্য একজন থিংকারের ধারনাকে অনুধাবন করি, একজন নগ্ন পুরুষ, যিনি পাথরে আসন গ্রহন করে আছে, তার মুষ্ঠিবদ্ধ হাত তার দাতের সংস্পর্শে, সে স্বপ্ন দেখছে। উর্বর চিন্তা ধীরে ধীরে তার মস্তিষ্কের গভীরে উম্মোচিত হচ্ছে। আর সে স্বপ্নদ্রষ্টা নয়,সে একজন সৃষ্টিকর্তা।

 রেঁনেসা সুচনা পর্বের শিল্পী সান্দ্রো বতিচেল্লি’র  ((Sandro Boticcelli) (১৪৪৫-১৫১০) ) শির্ল্পকম ‘চার্ট ওফ হেল’ (Chart of Hell, সময়কাল ১৪৮০-৯৫) সাথে দি গেইটস ওফ হেল এর র্ভাস্কযটির সাদৃশ্য থাকলেও মূলত  ভাস্কর রদ্যাঁর ‘দি গেইটস ওফ হেল’ –এর প্রধান  অনুপ্রেরণা ছিল ইতালির  মহাকবি দান্তে ( Durante degli Alighieri) (১২৬৫ -১৩২১) ও তাঁর মহকাব্য ‘দি ডিভাইন কমেডির’ (La divina commedia) পটভুমি। রেঁনেসা শিল্পী বতিচেল্লি থেকে শুরু করে আধুনিক শিল্পী ও রঁদ্যার সমসায়িক ব্রিটিশ শিল্পী গোষ্ঠি যারা প্রি-রাফিলাইট  নামে পরিচিত সকলেই মহাকবি দান্তে’র দ্বারা অনুপ্রেরিত হয়ে কাজ করে এসেছেন। সেই ধারণাকে আরো ভিত্তি দেয় যে, দি ডিভাইন কমেডি এর প্রথমঅধ্যায় L’inferno (নরক বা নরকের মত কোন একটি অবস্থা) নামে নামকরন করা হয় ‘লা পোর্টে ডেল অঁনফার’ ( La Porte de l’Enfer) বা  নরকের দরজা। আর  মহাকবি দান্তের  কারনেই দি থিংকারের  এর  প্রথম  নাম করন করা হয়েছিলো ‘দি পোয়েট’ ।

ভাস্কর  রঁদ্যার ১৮৮২ সালের দিকে ইংল্যান্ড ভ্রমনের ফলশ্রুতি, এবং তাঁর উপর  সমসাময়িক প্রি-রাফিলাইটদের  (Pre-Raphaelite) কাজের প্রভাব অস্বীকার করবার উপায় নেই। প্রি-রাফিলাইটদের শিল্পী গোষ্ঠিদের মূল  উদ্দেশ্য ছিল রেঁনেসা শিল্পের সৌন্দর্য্যবাদীতা আবার ফিরিয়ে নিয়ে আসার চেষ্টা করা। রঁদ্যার দি থিংকার ভার্স্কয দেখে আরো মনে পড়ে যায়, ইংরেজী সাহিত্যের কবি উইলিয়াম ব্লেক  (( William Blake) (১৭৫৭-১৮২৭)) এর মনোটাইপে  আঁকা সেই  ইলাসট্রেশনটির কথা। কিংবদন্তীয় আধ্যাত্বিকতাবাদের  কবির  আঁকা বিজ্ঞানী নিউটনের   ঝুকে থাকা ফিগারের সাথে দি থিংকারের  সাদৃশ্য রয়েছে। রেঁনেসা আমল  থেকে আজ অবধি মহান শিল্পী মাইকেলএন্জেলো দ্বারা অনুপ্রানিত হননি এমন কোনো ভাস্কর  বোধহয় নেই। ভাস্কর রঁদ্যাও শিল্পী মাইকেলএন্জেলোর প্রভাব মুক্ত ছিলেন না। ‘দি থিংকার’ ও  এর ব্যতিক্রম নয়, শিল্পী মাইকেলএন্জেলোর ভাস্কর্যের পেশীর সৌন্দর্য্যতা, নগ্নতা ও নান্দানিকতা দৃশ্যমান এই শিল্পকমর্টিতেও। খুব সহজেই  সাদৃশ্য খুঁজে পাওয়া যায় শিল্পী  মাইকেলএন্জেলোর গড়া ডেভিড বা ক্রাউচিং বয়ের (Crouching Boy) ফিগারের সাথে ।

মূলত রঁদ্যার ‘দি থিংকার’  কাজটিতে মহাকবি দান্তে, ইংরেজি কবি উইলিয়াম ব্লেক, রেঁনেসা শিল্পী বতিচেল্লি ও শিল্পী মাইকেলএন্জেলো, সর্বোপরি আধুনিক কালের শুরুর দিকের প্রি-রাফিলাইটদের  প্রভাবের সমন্বয় অত্যন্ত সুষ্পষ্ট; যদিও এটা এমন এক শির্ল্পকম যার মাঝে রেঁনেসা শিল্পের সৌর্ন্দয্যতা, গ্রীক শিল্পের আদর্শবাদীতা, আধুনিক শিল্পের নান্দনিকতার অদ্ভুত এক সমন্বয় খুঁজে পাওয়া যায়। কিন্তু কবি, শিল্পী , দার্শনিক কিংবা  স্বয়ং ঈশ্বর রুপে তাকে কতটুকু মানানসই  বর্তমান আধুনিক বিশ্বে ? সেই প্রশ্নে বিদ্ধ হতেই পারে উত্তর আধুনিক শিল্পরসিকদের মুক্ত মন।  কারণ বর্তমান সময় এখন চিন্তায় নিমগ্ন অলস, নিথর  ঈশ্বর দেখতে অভ্যস্থ  নয়। দ্রুতগামী ও নিয়ত পরিবর্তশীল, মুক্ত চিন্তার বিশ্বে সবাই চায় কর্মতৎপরতা ও  গতিশীলতার প্রতিকৃতি।

Leave a comment