কামিল ক্লদেল : বিস্মরণের অতলে সৃষ্টির যাদুকর …

কেউ যদি শিল্পী কামিল ক্লদেলের জীবন সম্পর্কে জেনে থাকেন, তবে অবশ্যই জার্মান দার্শনিক নীচাহ‘র ভালোবাসায় উন্মাদনা নিয়ে সেই বিখ্যাত উক্তিটি মনে পড়ে যাবে, “ভালোবাসায় পাগলামো থাকে, কিন্তু কারণ থাকে পাগলামোতেও।” বিনা কারণে এই পৃথিবীতে কিছুই ঘটবার নয় আর অনেক কিছু ঘটে যাবার পরে মনে হয়, এমন কোনো ঘটনার পুণরাবৃত্তি যেন না হয়, আর এই পৃথিবীতে। যার কারণগুলো চিহ্ণিত করতে গেলেই বরং বেশী অকারণ মনে হবে। জীবন ও প্রকৃতিকে মনে হবে অর্থহীন, শূন্য ও অসাড়। জীবনের পরে মৃত্যুর দেশে পা রেখেও যে আত্মা তৃপ্ত হতে পারেনি, এমন অকারণের কারণ খুঁজতে গেলেও, মনে প্রশ্ন জাগতে পারে; একজন মানুষের মৃত্যুর পরে কতটুকু জায়গার প্রয়োজন?

উত্তরটা সকলের জানা, সাড়ে তিন হাত জায়গা, এর বেশী নয়। বেঁচে থাকতেই বা একজন সাধারণ নির্লোভ মানুষের কতটুকুই বা প্রয়োজন। আর যদি সেই মানুষটি হন একজন শিল্পী, ‘প্রকৃত শিল্পী ’।

তবে তাঁর চাহিদা বেশী হবার কথা নয় । খেয়ে পরে বেঁচে নিজের শিল্পস্বত্তাকে বাঁচিয়ে রাখা … এইতো। কোনো জাগতিক বস্তুর প্রতি যার কোনো লোভ নেই। সেই নির্মোহ , জাতশিল্পী যে, যে জন্ম গ্রহন করেছেন প্রতিভা নিয়ে, তাঁর ভেতরে যে কল্পনার খনি; তা চাষাবাদের জন্য যেটুকু জমি আর তাঁর স্বপ্নকে উড়তে দেয়ার জন্য যেটুকু আকাশ প্রয়োজন, তার বেশীতো কোনোদিনো, কেনো প্রকৃত শিল্পী কারো কাছে প্রত্যাশা করেননি।

শিল্পী কামিল ক্লদেলও চেয়েছিলেন নিজ যোগ্যতায়, খেয়ে পরে বেঁচে থাকতে আর নিজের শিল্প সত্তাকে বাঁচিয়ে রাখতে। অবশ্য এই নিষ্ঠুর পৃথিবীতে আজো যোগ্যতা, সাফল্যের জন্য তেমন বড় একটা মাপকাঠি নয়। ভাগ্য বার বার বদলে দিয়ে যায় সব কিছু ; নিজ যোগ্যতায় সাজানো কল্পনার প্রাসাদকে, ভেঙ্গে ফেলে ঠুনকো তাসের ঘরের মতো ।

সেই তাসের ঘরের মতো সাজানো পরিপাটি পরিবারে, জটিল ও প্রানহীন মানব সমাজে , যদিও মাতৃত্বের মূল্য চড়া দামে নিলামে চড়ে, তবু কিছু মানুষের ভাগ্য এতটা সুপ্রসন্ন নয় যে মাতৃ ভালোসাবায় সিক্ত হবে সে জীবন , হবে উর্বর , হবে সফল। কারো বা সেই দুর্ভাগ্যের মূল্য পরিশোধের জন্য বিলিয়ে দিতে হয় নিজের জীবন , বিকিয়ে দিতে হয় অর্জিত সম্মান। মনোবিজ্ঞানীরা দাবী করে থাকেন, শৈশবে মাতৃ-ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত এমন মানুষেদেরই   শেষ পরিনতি হয়;   কঠিন কঠোর শিল্পী জীবন।

দীর্ঘ এই ভূমিকার গল্পটা কিন্তু নাতিদীর্ঘ । শিল্পী কামিল ক্লদেল বা ভাস্কর কামিল ক্লদেল, যাঁর জন্ম হয়েছিল পৃথিবীর উন্নত সভ্য দেশ ফ্রান্সে, ১৮৬৪ সালের ৮ ডিসেম্বরে এবং দীর্ঘ ৭৮ বছরের যন্ত্রণাময় জীবন যাপনের পর ১৯৪৩ সালের ১৯ নভেম্বর তিনি মৃত্যু বরণ করেন।

অল্প বয়সেই তাঁর শিল্প প্রতিভা প্রস্ফুটিত হয়েছিল। বাবার উৎসাহে তিনি শিল্পী হবার শিক্ষা নেয়ার সৌভাগ্যও লাভ করেন; সে সুত্রে ১৮৮১ থেকে জীবন শুরু হয় পারীতে, মা , বোন আর ছোট ভাই পলের সাথে । শৈশবেই পাথর আর মাটির প্রতি অদম্য আকর্ষণ কামিলের শিল্পী সত্ত্বার জানান দিয়েছিল, ভাস্কর আলফ্রেড বোশে’র কাছে আকাদেমী কোলারসিতে প্রথম শিল্পী হবার প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা শুরু হয় তরুনী কামিলের। সে সময় কিন্তু নারীদের জন্য রুদ্ধ ছিল একোল দে বোজার্ট (École des Beaux-Arts) এর রক্ষনশীল দরজা।

তবে কামিলের সম্ভাবনা নজর এড়ায়নি অনেকেরই, ‘একোল দে বোজার্ট’- এরই পরিচালক পল দুবোয়া ১৮৮২ সালে, রঁদ্যার সাথে প্রতিশ্রুতিময় কামিল ক্লদেলকে পরিচয় করিয়ে দেন; ভাস্কর রদ্যাঁর উপর শিক্ষাদানের দায়িত্ব পড়ে এবং কামিল রদ্যাঁর ওয়ার্কশপে যোগ দেন। সেখান থেকেই এই ভয়ানক হৃদয় বিদারক গল্পের সূচনা । শুরু হলো   ভালোবাসা নামক এক অলীক স্বপ্নের । যার মাশুল শুধু একা কামিলকেই দিতে হয়েছিলো, নিজের জীবন দিয়ে, নিজের শিল্পী সত্ত্বাকে বিসর্জন দিয়ে । ভাস্কর রদ্যাঁ যখন রেনেসাঁর শিল্পী মাইকেলএন্জেলো ও ধ্রুপদী কবি দান্তের প্রভাবে অনুপ্রাণিত হয়ে কাজ করছেন , তখন তাঁর জীবনে সত্যিকার ভালোবাসা, তীব্র আবেগ আর রোমাঞ্চকর অনুভূতির জোয়ার এনে দেয় তরুনী মেধাবী শিল্পী কামিল।

তাদের দীর্ঘ দিনের গভীর সম্পর্ক পরস্পরের কাজকেই সমানভাবে প্রভাবিত করেছে বলে মনে করা হয় যদিও, তবে কামিল রদ্যাঁর কাজকে প্রভাবিত করেছিলেন ভিন্ন একটি মাত্রায় ও গভীরভাবে, যা সুস্পষ্ট হয় কামিলের সাথে পরিচিত হবার আগে এবং পরে করা রদ্যাঁর কাজগুলো যদি তুলনা করা হয়। ভাস্কর রদ্যাঁকে কামিল তাঁর কাজে ডেকোরেটিভ স্টাইল ভেঙ্গে বের হয়ে আসতে সাহায্য করেছিলেন। কামিলের প্রভাবেই রদ্যাঁর কাজগুলো হয়ে উঠেছিল আরো বেশী আবেগময়, অনুভূতি সিক্ত, অর্থবহ, অভিব্যাক্তিময়, যা পরবর্তীতে রদ্যাঁর অনন্য নিজস্বতা হিসাবে চিহ্নিত করেছেন শিল্প সমালোচকরা। ধীরে ধীরে রদ্যাঁর কাজে স্পষ্ট হয় আধুনিকতা; একসাথে জড়ো হয়ে থাকা ফিগারকে ভেঙ্গে রদ্যাঁ শিখেছিলেন একক বিষয়বস্তু ভিত্তিক কাজ করতে সাহসী হয়ে উঠতে, শিল্পী রদ্যাঁ এর নতুন করে পাওয়া এই আবেগময় আত্মবিশ্বাস দর্শকের স্পর্শ করেছিল সহজেই ।

রদ্যাঁর জনপ্রিয়তাও দিন দিন আকাশচুম্বি হতে থাকে আর কামিল পা বাড়ায় অবহেলার এক অন্ধকার জগতের দিকে। ১৯৮২ থেকে ১৯৯৮ সাল পর্যন্ত কামিল ও রদ্যাঁর গভীর সম্পর্ক তাদের শিল্পচর্চাকে এমন ভাবে প্রভাবিত করে যে, রঁদ্যার কাজে নারী-পুরুষের শারীরিক ভালোবাসার উন্মত্ততা দেখা যায়। আর কামিল তো অল্পবয়স থেকেই তীব্র আবেগময়ী। কামিলের কাজ তখন সময়ের অনেক আগেই ডানা মেলেছে বলে ঠিক মতো কেউই তাকে মূল্যায়ন করতে পারেনি। সেটা বোঝার মত বোদ্ধা শিল্পরসিকের সংখ্যাও খুব কম ছিলো তখন।

রদ্যাঁ কামিলকে বিয়ে করে সামাজিক সম্পর্কে আবদ্ধ করতে অস্বীকার করলে, কামিল মানসিকভাবে ভেঙ্গে পড়েছিলেন। মনে করা হয়, সে কারণেই কামিল বেশ কয়েকবার গর্ভপাতের সিদ্ধান্ত নেন, অথবা সন্তার জন্মদানের পরে, দান করে দেয়া হয় । কামিল সেসব দুঃসহ যন্ত্রণার স্মৃতি ভুলতে পারেননি কোনোদিনো । ভাস্কর রঁদ্যার সাথে কামিল এর বয়সের ব্যবধান ছিলো অনেক , প্রায় ২৪ বছর।

গল্পের অন্যদিকে তাকালে দেখা যাবে যে, রদ্যাঁর সাথে অন্য এক রমণীর তখন সম্পর্ক ছিলো দীর্ঘদিনের । সাধারণ প্রতিভাহীন এক রমণী , নাম রোজ বিউরেট। রঁদ্যার মডেল ছিলো রোজ । রঁদ্যার একটি সন্তানের মাও ছিলো সে, যদিও সব কিছুই ছিলো সমাজে বেশ গোপনীয় এবং তাদের মৃত্যুর অল্প কিছু দিন আগে, ১৯১৭ সালে তারা বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছিলেন । রদ্যাঁ কামিল ও রোজ দুজনের সঙ্গেই একই সাথে সম্পর্ক টিকিয়ে রাখতে আগ্রহী ছিলেন সেবিষয়ে তাতে কোনো সন্দেহ নেই । কিন্তু কামিলের পক্ষে তার ভালোবাসাকে ভাগ করে নেয়া সম্ভব ছিলো না যেমন, ঠিক তেমনই অসম্ভব ছিলো রঁদ্যার এই দ্বিচারী মনোভাবকে মেনে নেয়া। এরপর কামিল রঁদ্যার সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে দেয় চিরদিনের জন্য। দীর্ঘ প্রায় তের- চৌদ্দ   বছরের সম্পর্কের কোনো গন্তব্য না দেখে কামিল রঁদ্যার সাথে সম্পর্ক বিচ্ছেদের সিদ্ধান্তে অটল থাকেন । ১৮৯৮ সালের পর তাদের আর আর দেখা হয়েছে বলে এমন কোন তথ্য পাওয়া যায়নি ।

১৮৯৯ থেকে ১৯১৩ সাল পর্যন্ত কামিল পারীর কাই বোরবোঁতে নিজের স্টুডিওতে কাজ করে গেছেন একটানা স্বতন্ত্র ও স্বাধীন ভাবে; কোনো কোনো সূত্র থেকে জানা যায় কামিল তাঁর শেষ ভাস্কর্য গড়েন ১৯০৫ সালে। এ সময়টিতে ও সবসময় ‍কামিলের বাবা তাঁকে সহযোগিতা করে গেছেন। অন্যদিকে কামিলের মা ও ভাই কবি পল ক্লদেল ছিলেন গোড়া ক্যাথলিক। শৈশব থেকে যদিও বা কামিলের সাথে তাঁর ভাই ও বাবার সম্পর্ক ভালো ছিলো কিন্তু পরবর্তীতে পল কামিলের সঙ্গে তেমন কোনো ভালো সম্পর্ক রাখার চেষ্টা করেননি; সে তার গোঢ়া ধার্মিক মাকে সহযোগিতা করে গেছে তার নিজের প্রতিভাবান মেয়েকে নানা ধরনের মানসিক অত্যাচার অব্যাহত রাখতে, যা চুড়ান্ত রুপ ধারন করে কামিলের বাবার মৃত্যুর পরপরই। হয়তোবা সম্পত্তির লোভও ছিলো জড়িত, জড়িত ছিলো স্বার্থ। কামিলের গর্ভপাতের ঘটনাটি তাঁকে তাঁর নিজ বাড়ী ও পরিবার থেকে চলে আসতে বাধ্য করা হয় । বিশেষ করে তাঁর ধর্মান্ধ মা ও ভাই , তাঁর শিল্পী পরিচয় ও রঁদ্যার সঙ্গে বিবাহ বর্হিভূত সম্পর্ককে মেনে নিতে পারেনি কোনো দিনো ও কোনো ভাবে ।

কামিলে মা, অত্যন্ত কঠোর প্রকৃতির একজন মানুষ। মা হিসেবে ছিলেন নির্লিপ্ত । নিজ সন্তানের প্রতি তেমন কোনো টান অনুভব করতে কোনদিনও তাকে দেখা যায়নি, কিছু কর্তব্য পালন করা ছাড়া । ভালোবাসা বা আদর যত্নের অভাব কামিল অনুভব করেছে রন্ধ্রে রন্ধ্রে আজন্ম। মায়ের অবহেলা কামিলের ভেতর মানসিক অসুস্থ্যতার প্রথম বীজ বপন করেছিলে, কিছু উপসর্গও নজরে এসেছিল পরিচিতজনদের। এর উপরে এস ভরে করে রদ্যাঁর নিষ্ঠুরতা ও কৌশলী মনোভাব ও সর্বোপরি কামিলের প্রতিভাকে ব্যবহার করে, রঁদ্যার সমাজে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার প্রচেষ্টা । সব মিলিয়ে প্রতিভাবান , সৎ ও স্বাধীনচেতা মেয়ে হয়ে সমাজে মাথা উচু করে দাড়াবার কোনো সুযোগ ও সহযোগিতাই পাননি কামিল । কামিল তাঁর অসাধারণ প্রতিভাকে বিকশিত করতে পারেনি র্দুভাগ্যজনক ভাবে ।

যদিও কামিলের শিল্প প্রতিভার সুনাম চারিদিকে ছড়িয়ে গেছে এর মধ্যেই । পারী জেনে গেছে গভীর চোখের অধিকারীনি, সুন্দরী, বুদ্ধিমতি এই মেয়েটি একদিন খ্যাতিমান ভাস্কর হবেই। ১৯০৫ সালে, এগেন ব্লট তাঁর গ্যালারিতে আয়োজন করেন কামিলের প্রথম একক ভাস্কর্য প্রদর্শনী । কিছু উঠতি অনভিজ্ঞ শিল্পসমালোচক, কামিলকে কঠোরভাবে সমালোচনা করেন, আক্রমানত্মক আর রূঢ় ভাষায়; স্পষ্টতই পারী প্রস্তুত ছিল না তখন কামিলের আবেগ মন্থিত ভাস্কর্যগুলো দেখতে; অনুভূতিহীন অবয়ব সর্বস্ব ভাস্কর্য তখন ধর্মীয় থীমকে অবলম্বন করে ছিল; প্রসঙ্গক্রমে মনে করা যেতে পারে ইমপ্রেশনিষ্টদের ঠিক এমনভাবে প্রথম দিকে হেনস্থা হতে হয়েছিল রক্ষণশীল আর খুব ধীর লয়ে নতুন পরিবর্তনকে আত্মগত করতে পারা সমালোচকদের এবং ইতিহাস বলে সময়ের কাছে এদের পরাজয় অবশ্যমম্ভাবী ।

জানা যায় এরপর থেকে কামিল আর কোনো ভাস্কর্য নির্মাণ করেনি । কামিলের শৈল্পিক দুইহাতে আর কেউ দেখেনি তুলে নিতে হাতুড়ি বাটাল। কামিলে মানসিক সাস্থ্যর অবনতি ঘটলে দেখা গেছে, সে অভিযোগ করছে রঁদ্যা তাঁর চিন্তা ও পরিকল্পনা চুরি করেছে বলে । নিজেকে বিলিয়ে দিয়ে ভালোবাসার যন্ত্রণায় দগ্ধ হয়ে কামিল ধ্বংস করে ফেলেন তাঁর অনেক সৃষ্টি । মাত্র ৯০ টি ভাস্কর্য ও ড্রইং আজ শুধু টিকে আছে ।

কামিলের বাবা জীবিত অবস্হায় কামিলকে পূর্ণ সহযোগিতা করে গিয়েছিলেন। কিন্তু তাঁর মৃত্যু পরপরই (মাত্র ৩ দিন পরে) কামিলের মা ও ভাই ষড়যন্ত্র করে তাঁকে ভিল এভরার্ড (Ville Évrard) , নামে একটি মানসিক রোগীদের জন্য আসাইলামে ভর্তি করিয়ে দেন আইনের সহায়তা । ১৯১৩ সাল থেকে ১৯৪৩ সাল, জীবনের শেষ তিন দশক পৃথিবীর এই অনন্য অসাধারণ প্রতিভাকে ঠেলে দেয়া হয় অন্ধকার গুহায়। এক নিষ্পাপ হৃদয়কে একদিকে রদ্যাঁর ভালোবাসার মিথ্যা নাটকের আগুনে পুড়তে হয়েছে ,অন্যদিকে মা ও ভায়ের অন্ধ ধর্মান্ধতার বলি হতে হয়েছে।

এই অসাধারণ শিল্পীকে জোর পূর্বক সেই মানসিক হাসপাতালে আটকে রাখা অবস্হায়, তাঁর মা কিংবা বোন, কেউই কোনো দিনও দেখা করবার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেনি । তেমন বন্ধু বা আত্মীয় বা শিল্প সমাজকেও কাছে ঘেষতে দেয়া হয়নি তাঁর মায়ের প্রত্যক্ষ আদেশে; কথিত আছে যে, ভাস্কর রদ্যাঁ কামিলকে টাকা পাঠিয়ে সাহায্য করাতো , তাঁর মানসিক হাসপাতালে অবস্হানের সময়। যা নিতান্ত করুনা ছাড়া অন্য কিছু ভেবে নেয়া সম্ভব না কারো পক্ষে । এই সুদীর্ঘ ৩০ বছরের বন্দী যন্ত্রনাময় জীবনে, শুধুমাত্র ছোটো ভাই পল কয়েকবার দেখা করতে এসেছিলো কামিলের সাথে। শেষ জীবনে এসেছিলেন ব্রিটিশ ভাস্কর জেসি লিপসকম্ব (Jessie Lipscomb), এক সময়কার ভালো সঙ্গী কামিলের; আর তেমন কাউকে কোনোদিনো দেখা করতে দেয়া হয়নি তাঁর সাথে পরিবারের পক্ষ থেকে। এমনকি , কামিলের মৃত্যুর পর , তাঁর পরিবার থেকে কোনো যোগাযোগ করা হয়নি বা তাঁর শেষকৃত্যতেও কেউ যোগদান করেননি। অবহেলিত পরিত্যক্ত কামিলকে পারিবারিক কবরস্হানেও স্হান দেয়া হয়নি। অবশেষে তাকে, সমাধিস্থ করা হয় সাধারণ এক সমাধি ক্ষেত্রে।

হায় নিয়তি ! পৃথিবীর অনত্যম শ্রেষ্ঠ এক ভাস্কর শুয়ে আছেন পৃথিবীর কোনো এক অজানা অন্ধকারে ।

‘পারী ’ কে সবাই জানে ভালোবাসার শহর নামে। শিল্পকলার লীলাভূমি ও বটে । সেই পারীর এক অনন্য প্রতিভাবান ভাস্করের এমন করুন মৃত্যু, পারী কি পারবে কোনোদিনো ভুলে যেতে ? পারী কি পারবে কি ক্ষমা করতে ? যদিবা কেউ কোনোদিন দেখে সেইন ( Seine) নদীর তীরে বসে কোনো প্রেমিক প্রেমিকা যুগল গভীর আলিঙ্গনে চুমু খাচ্ছে; যদি সেই দৃশ্য দেখে কারো মনে পড়ে যায়, বিখ্যাত এক ভাস্করের বিখ্যাত সৃষ্টির কথা ‘দ্যা কিস ; মনে কি পড়বে না তখন, কামিলের কথা ? সেওতো একদিন কাওকে (রঁদ্যা) গভীরভাবে ভালোবেসে বঞ্চিত হয়েছিলো ।

স্রষ্টাও যে হন্তা হয়ে উঠতে পারে তার জ্বলন্ত উদহরণ হলো ভাস্কর ‘রঁদ্যা’ ।

যে হাতে সে গড়েছে শিল্পকে । যে হাতে সে রক্ষা করেছে সৌন্দর্য, দিয়েছে প্রাণ পাথরে । সেই হাতেই সে হত্যা করেছে প্রাণপ্রাচুর্যে পূর্ণ এক তরুনীর স্বপ্নকে । সেই হাতে সে অন্ধকারে ছুড়ে ফেলে দিয়েছে এক শুদ্ধতম ভালোবাসাকে ; শুধুমাত্র নিজের স্বার্থ রক্ষার্থে । যে একদিন পুনরুজ্জীবিত হয়েছিলো নিষ্পাপ এক শিল্পী সত্তার স্পর্শে,   তাঁর সৃষ্ট ভাস্কর্যে এসেছিলো প্রাণের জোয়ার, ভালোবাসার ফুল্গধারা। নিয়তির অদ্ভুত ফেরে গত কয়েক দশকে শিল্পবোদ্ধারা অনুভব করতে পেরেছেন কামিল ক্লদেল এর অসাধারণ প্রতিভাকে, আর তাই আজ রদ্যাঁ একক ভাবে উচ্চারিত কোন নাম নয়, কামিলের সাথে তাঁর সৃজনশীল সময়গুলোই রুপান্তরিত হয়েছে শিল্পী হিসাবে তাকে বিচার করার একটি অনস্বীকার্য একটি মানদন্ডে; লেখক গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ যেমন বলেছিলেন; মৃত্যু আসে না বার্ধক্যে, মৃত্যু আসে বিস্মৃতি থেকে ।

আর তাই যে কোনো মূল্যে, কামিল ক্লদেলের নামটিকে ভুলতে দেয়া যাবে না কোনো ভাবেই, তলিয়ে যেতে দেয়া যাবে না বিস্মৃতির অতলে। কামিল ক্লদেল হয়ে উঠুক সেই শাশ্বত সেতুর নাম যার, শুরু হবে ভালোবাসার উন্মাদনায় আর শেষ হবে শিল্পকলার উন্মাদনায়। যে সেতুতে একদিন পা বাড়িয়ে দেবে ভবিষ্যতের শিল্পী …প্রেমিকরা ।

Leave a comment