বিশ্বাসের তাঁতে বোনা জীবনের দগ্ধ মসলিন

শিল্পীর শিল্পী হয়ে ওঠার প্রক্রিয়ায় রহস্যময়তা অনুপস্থিত থাকে যখন শিল্পী আজন্মই শিল্পী। আসমা সুলতানা শিল্পী হয়েই জন্মেছিলেন। যার সহজাত অন্তর্গত ভাবনাগুলোই সৃজনশীল রুপে বিবর্তিত হয়েছে পরিশীলিত একটি অভিব্যক্তিতে, যেখানে সৌন্দর্য, আবেগ, সময়ের অতিক্রমণ আর সযত্নে লালিত স্বপ্নগুলো তাদের থমকে থাকা শ্বাস ফেলতে পারে মহাকাব্যের পরিসরে। যারা মনের সংযোগকে সুনিশ্চিৎ করে ২০০৪ এ আসমা সুলতানার প্রথম একক প্রদর্শনী ‘এপিক’ – এর ক্যানভাসগুলোয় চোখ রেখেছিলেন, কিংবা শিল্পীর বিবৃতিটি পড়েছিলেন তারা হয়তো আসমার সাম্প্রতিক কাজ দেখলেই অনুভব করতে পারবেন শিল্পীর সেই মহাকাব্যিক যাত্রার গন্তব্যটির অভিমূখ। আর যারা প্রথমবারের মত দেখছেন, তাদের মনের ভিতর ভেসে ওঠা প্রশ্নটির উত্তর প্রশ্নের সম্পূরক হয়ে ওঠে যখন মৃদুভাষী শিল্পী আমাদের স্মরণ করিয়ে দেন, তার সৃষ্টিকর্মে তিনি তার জীবনের কথাই বলছেন, এবং তিনি তাদেরই একজন, আমাদের আগেই যারা আমাদের কথা বলেন। আমাদের পক্ষে অনুভব করার সম্ভাবনা আরো ত্বরান্বিত হয় যখন আমরা বুঝতে পারি, আসমা সুলতানা ক্রমশ দুর্লভ হয়ে ওঠা সেই শিল্পীদের একজন যার শিল্পকর্মের মূলভাবনা আত্মজৈবনিক। শিল্পী হিসাবে বৈচিত্রময় সাংস্কৃতিক-ভৌগলিক পরিবেশে নিজের পরিচয় খুঁজে নেবার সংগ্রাম, মানুষ হিসাবে মাথা উঁচু করে দাড়াবার নিরন্তর যুদ্ধ, অপমান, বঞ্চনা আর আত্মত্যাগের নানা আখ্যান প্রতীকী রুপ খুঁজে পেয়েছে যেমন তার ক্যানভাস, প্রিন্ট এবং স্থাপনা শিল্পে, তেমনি তার কবিতার শব্দে।

DSC_0321.JPG
এ বছর নভেম্বরের শীতে টরোন্টোর গ্যালারী ফিফটিতে শিল্পী আসমা সুলতানার সাম্প্রতিকতম প্রদর্শনী ‘লেটার টু মাই আনবর্ন চাইল্ড’ ছিল তার সেই মহাকাব্যিক যাত্রারই আরেকটি সংক্ষিপ্ত বিরতি, শিল্পীর মনোজগতের শারীরিক একটি প্রকাশে দর্শকরা সেখানে আমন্ত্রিত হয়েছিলেন সম্প্রসারিত সমন্বয়পন্হী একটি মনে প্রবেশ করার জন্য। শিল্পীর কথোপকথনের শব্দহীন অভিব্যক্তিগুলো যেখানে রুপ পেয়েছিল ছাদ থেকে মেঘের মত ভেসে থাকা শিশুদের বারোটি সাদা জামা, কিংবা ছাদ থেকে মাটি স্পর্শ করা জরায়ুর রক্তাক্ত দুটি হাতের ছাপসহ দীর্ঘ একটি জামা, যন্ত্রণার অস্বস্তিকর চুলসহ নকশি কাজের হৃদপিণ্ড, জরায়ুর বেশ কটি রুপ, ভ্রূণ, কাপড়ের খামে প্রজাপতির ভাঙ্গা ডানা, কিংবা শুকনো বীজের একটি ডাল, সিল্কের ফিতায় চুল দিয়ে সেলাই করা সময়ের সাক্ষী হয়ে তাকিয়ে থাকা অষ্টাশিটি নক্ষত্রপুঞ্জ, কিংবা কাগজে আঙ্গুলে ছাপে আঁকা অনুপস্থিত শিশুর জামায়।
শিল্পীর অজাত শিশু শিল্পীরই শিল্পকর্ম, মায়ের জরায়ুতে যেমন করে মায়ের পুষ্টি নিয়ে বেড়ে ওঠে ভ্রূণ, শিল্পী মনের স্বপ্নে আর আশায় পুষ্ট হয় তার শিল্পকর্ম, যেন শরীরের বাইরে জন্ম নেয়া শিশু। শিল্পী যে শিশু নিজে গর্ভে ধারণ করেননি, সেটি আসলে তারই মনের সৃষ্টি, যা রুপ পায় তার নিজের হাতে বানানো শিশুর জামায়, কাপড়ে তোলা নকশি কিংবা আঙ্গুলের ছাপে আঁকা রেখাচিত্রে। আরো বিস্ময় অপেক্ষা করে যখন দেখা যায় শিল্পী পরম মমতায় সংগ্রহ করা নিজেরই মাথার পরিত্যক্ত চুলকে তার শিল্পকলার অংশ করে নিয়েছেন। তার বৈশিষ্ট্যসূচক দীর্ঘ চুল যখন মাথা থেকে পড়ে যায়, কিংবা চিরুনীর ভাঁজে আটকে যায়, সেই সব ‍পরিত্যক্ত চুল তিনি একটি একটি করে সংগ্রহ করেন সযত্নে, যে যত্ন আর আবেগময় ভালোবাসা তিনি কারো কাছে পাননি। আর সেই পরিত্যক্ত চুলকে তিনি তার শিল্পকলার অংশ করে নিয়েছেন, আর এই ঝরে পড়া আর কিংবা শিকড়চ্যুত চুল প্রতীকী তাৎপর্যে অর্থবহ হয়ে উঠে শিল্পী জীবনের অভিজ্ঞতার নানা স্তরে। তার সেলাইয়ের কাজে সুতোকে প্রতিস্থাপিত করেছে চুল, আর এই চুল সংগ্রহ,পরিষ্কার ও তাদের সংরক্ষণ, সব কিছুই তার কাছে খুব সতর্কতার সাথে পরিকল্পিত ধারাবাহিক কোনো কাজ সদৃশ, যেন কোনো শিশুর প্রতিপালন। এভাবেই শিল্পী নিজের সাথে নিজের একটি সম্পর্ক গড়ে তোলেন, রূপান্তরিত হন তার নিজেরই জননী এবং সন্তানে।

dsc_2470


শিল্পীর ‘লেটার টু মাই আনবর্ন চাইল্ড’ কল্পনার একটি প্রবেশ আর প্রস্থান বিন্দু, ম্যাধাকর্ষণমুক্ত বিষন্নতার সাথে একটি ক্ষতকে ব্যাখ্যা করার প্রয়াস। চিরায়ত নকশি কাঁথা সেলাইয়ের একটি ভিন্ন রুপকে নতুন করে উপস্থাপন করা, যাকে শিল্পী বিনির্মাণ করেছেন এর গল্প বলার গোপন শক্তিটির সম্ভাবনাকে যাচাই করার জন্য, সচেতন স্তরে যা শনাক্ত করার আগেই এর প্রথাগত উপস্থাপনায় সামাজিক মনস্তত্ত্ব আর আড়ষ্ট নিয়ম প্রায়শই এর গল্প বলার আর স্বাধীন অভিব্যক্তি প্রকাশের ক্ষমতাটিকে শুষে নেয়। আমার অজাত শিশুর প্রতি চিঠির কাজগুলো শিল্পীর যে যাপিত জীবনের অভিজ্ঞতার প্রতিনিধিত্ব করছে, সেই জীবনে প্রবেশ করার দরজাটি সংবেদী কোনো দর্শকের মনে হতে পারে একটি ক্ষতচিহ্ন, যেখানে প্রবেশ আর বের হয়ে আসার পথেই শিল্পীর যন্ত্রণাময় শ্বাসরুদ্ধকর অভিজ্ঞতাটি প্রতিস্থাপিত হয় নন্দনতাত্ত্বিক সমীকরণের উভয় পাশেই। বিষন্নতার নির্ভার সেই অনুভূতিগুলো শিল্পীকে আমাদের আরো নিকটবর্তী করে নিজেদের স্বীকৃতিহীন অনুভূতিগুলোর দুঃসহ বিলাপে।

সদ্য স্বাধীন হওয়া বাংলাদেশের কৃষ্ণতম অধ্যায়ের প্রেক্ষাপটে জন্ম নেয়া শিল্পী তার পরিবারের টিকে থাকার অর্থনৈতিক সংগ্রাম, অবহেলিত শৈশবের অমোচনীয় স্মৃতিকে অনায়াসেই চিহ্নিত করতে পারেন তার জীবনের গল্প বলার জন্য শিল্পকলায় আশ্রয় খুঁজে পাওয়ার অভিজ্ঞানে। নিজের স্বপ্নকে বাঁচিয়ে রাখার অমসৃণ সংগ্রামটিকে আসমা নিঃসংকোচে তুলনা করতে পারেন দমকা বাতাস থেকে সারাক্ষণই মোমের প্রায় নিভু নিভু শিখাকে বাঁচানোর অন্তহীন প্রচেষ্টার সাথে। শিল্পী মনে করিয়ে দেন ভালোবাসার মৃত্যুর প্রথম শিকার হচ্ছে সত্যিকারের স্মৃতিগুলো; সততা, নিরপেক্ষতা আর শ্লীলতার সাথে স্মৃতিচারণের কোনো সুযোগ থাকেনা যখন, যা বর্তমানের জন্য খুবই অস্বস্তিকর, অসুবিধাজনক আর গর্হিত। আমাদের ব্যর্থতা আর হতাশার উৎসবে যা অশরীরি আত্মার মতই অনাহুত। কিন্তু শিল্পী বিস্মরণের সেই দমকা হাওয়ার মুখেই তার সততার প্রদীপ শিখাটি তুলে ধরেন, কতটা পথ সেটি আলো দেখাতে পারে সেটি জানার জন্য। তার স্বভাবসূলভ সূক্ষ্মতায় তিনি মনে করিয়ে দেন বৌদ্ধিক আর নন্দনতাত্ত্বিক অভিব্যক্তিতে নৈরাশ্যবাদ খুব সহজ, এমনকি আকর্ষনীয়, , কারণ এটি আমাদের মুক্ত করে সমাধান খোঁজার দূরুহ দ্বায়িত্ব থেকে, আমাদের উত্তেজিত করে গুরুত্বহীনতার মহাউৎসবে মত্ত হতে। কিন্তু শিল্পী সেটি চাননি, কোনো শল্য চিকিৎসকের ছুরি হাতে তিনি মহাজাগতিক সেই বাস্তবতাটিকে উন্মুক্ত করেন, বোধগম্য মিথ্যার গভীরে দুর্বোধ্য একটি সত্য।


শিল্পীর কাজে তীব্রতম অনুভূতির সূঁচ ফোটানো জমিন যেন সেই অস্থির প্রান্ত, শিল্পী যেখানে কিছু খুঁজে বেড়ান, হয়তো সেখানে, এর পেছনে লুকানো আছে, যা তার নিজের খুব গভীরেই, কিন্তু কি সেটি, শিল্পী বলেন তার সত্তা, তার আত্মপরিচিতি। শিল্পী মনে করিয়ে দেন আমরা এমন একটি যুগে বাস করি যেখানে আমাদের সেই সত্তা আর আত্মপরিচয় আবৃত আর আশ্রিত ভুল কোনো ঠিকানায়। যখন আমাদের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতাগুলোর সাদৃশ্যতা এত বেশী হয়ে ওঠে, দুঃখজনকভাবে আমরাও সদৃশ্য হয়ে উঠি, খুব সহজে যা সৃষ্টি করে সংশয়, কারণ পাশের অন্য কোনো মানুষ থেকে আমরা আর কতটাই ভিন্ন হতে পারি, খুব সামান্য, কোনোমতে স্পর্শযোগ্য, আর যদি এর সাথে ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতাও যুক্ত হয়, এই পরিস্থিতি আমাদের জানিয়ে দেয় মানুষ কেবল অন্য মানুষকেই অনুকরণ করে, তাদের দৃষ্টিভঙ্গি আমরা পরিসংখ্যানগতভাবে পরিমাপ করতে পারি, তাদের মতামতকে প্রভাবিত করতে পারি, আর সে কারণে মানুষ এখন কোনো একক ব্যক্তি নয় বরং একই জনগোষ্ঠীর উপাদান।

DSC_3575


ব্যক্তি পরিচয়ের এই অনিশ্চয়তায় শিল্পীর সূঁচ তার নিজের সত্যটি অনুসন্ধান করেন নিজের গভীরে তার আত্মপরিচয়ের শনাক্তকারী চিহ্নগুলোকে আরো প্রকট করে। অন্যভাবে হয়তো বলা যায় শিল্পী নিজেকে প্রশ্ন করেন তার সত্তার সীমানাটিকে নির্দেশ করার জন্য। তার নিজের জীবনের অভিজ্ঞতার সেই প্রকটতা তাকে কতটুকু বদলে দিয়েছে, বর্তমান আর অতীতের সংযোগকে তিনি কি স্পর্শ করতে পারবেন অবিচ্ছিন্ন জীবনেরই একটি অংশ হিসাবে। কোথায় সেই সীমানাটি, যেখানে শিল্পী নিজেকে অনন্য করেন অসংখ্য অভিন্ন সত্তা থেকে। অন্য শিল্পীর ব্যতিক্রম তিনি আসলেই নিজের কথাই বলেছেন, শিল্পী জীবনের শুরুর সেই অভ্যাসগত প্রক্রিয়াকে তিনি পরিত্যাগ করতে পেরেছেন আর তার ফ্রেমে আশ্রয় পেয়েছে বিশুদ্ধ কিছু প্রতিক্রিয়া, আর সেটাই তাকে ভিন্ন করে তুলেছে ও তুলছে। আধুনিক শিল্পকলার অন্ধবিশ্বাসীদের তিনি প্রতিহত করেন, যারা সেই ঐতিহ্যবাহী আর আধুনিক শিল্পকলার মাঝে দেয়াল তুলে দিয়েছেন, শিল্পীর কাছে তাই শিল্পকলার ইতিহাস তার সামগ্রিকতায় পূর্ণ, আর সেকারণে সেখানে সরল কোনো বার্তা নেই আপাত সরল উপকরণের ভীড়ে, আর আমাদের তিনি প্ররোচিত করেন কখনো নিঃশর্ত আত্মসমর্পন অথবা কখনো কৌশলগত প্রস্থানের মাধ্যমে নিজের খুব ভিতরের একটি অনুভূতির সাথে বোঝাপড়া করার জন্য।


শিল্পী জানেন বর্তমানে শিল্পকলা তত্ত্বের অতিকথনে আড়ষ্ট, যা শিল্পকলাকে সরাসরি স্পর্শ করতে দেয়না তার দর্শককে, শিল্পী খুব সরলতায় সেই পথটি অস্পষ্ট করে দিয়েছেন যেন এটি আবদ্ধ না হতে পারে শুধুমাত্র তার ব্যক্তিগত জীবনের অভিজ্ঞতার অকপট স্বীকারোক্তি হিসাবে। আমরাও যেন শিল্পীর আপাতদৃষ্টিতে উপস্থাপিত নৈরাশ্যবাদকে ‍রুপান্তরিত করতে পারি আনন্দময় নৈরাশ্যে, কারণ আমরা আমাদের নিজেদের শিকড়টাকে সেখানে স্পর্শ করছি, আর সেটাই সত্যিকারের নন্দনতাত্ত্বিক অনুভূতি, বিক্ষত হৃদয়ের এই আর্তনাদ তাই আমাদের শঙ্কিত করেনা, এর উপস্থাপনের সরলতা মনে করিয়ে দেয়, শিল্পী আমাদের আগেই আমাদের কথাগুলো বলছেন। আমরা আমাদের প্রতিবিম্বকে দেখি, আমাদের গভীরের লুকিয়ে থাকা আমাদের অনন্য সত্তার হীরক খণ্ডটি, আমাদের যে প্রতিবিম্বটি মনে করিয়ে দেয় সেই শক্তিময় দূর্বল আর অসীমভাবেই ভঙ্গুর সত্তাটিকে, যা আমাদের শরীরের মধ্যে এখনও কম্পমান, যেখানে আমরা অর্থহীন দুর্ঘটনার এই জীবনটিকে কাটানোর কারণ অনুসন্ধান করি।

নিজের কাজকে তিনি চিহ্নিত করেছেন আত্মজীবনীমূলক হিসাবে। আমরা কাছাকাছি পৌঁছে অনুভব করতে পারি শিল্পী কেন তার শিল্পকলার সাথে সম্পর্কটাকে উপস্থাপন করছেন জীবন্ত কোনো চরিত্রের মত – বিদ্যমান সম্পর্কগুলো যেখানে অনির্বচনীয় জটিলতায় ভারাক্রান্ত। আর সেই সম্পর্কগুলো ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়াগুলো আমাদের বোধগম্যতার কাছে অতিক্রম্য হয়ে ওঠে শিল্পী যখন নিজের পরিবার আর স্বদেশের সাথে নিজের সম্পর্কটাকে একই সমান্তরালে তুলনা করেন। তার সাহসী স্বীকারোক্তি জানান দেয়ে শব্দতো বটেই শিল্পের প্রেক্ষাপটে যা ব্যাখ্যা করা যন্ত্রণাময় আর কঠিন – তারপরও তার সৃষ্টিকর্মের মূল ভিত্তি সেই সম্পর্কগুলোই, নিজের যাপিত জীবনের অভিজ্ঞতাকেই আমরা তার কাজে মূখর হয়ে উঠতে দেখি প্রত্যাখান আর বিসর্জনের তীব্র নীরবতায়। পরিচিত সম্পর্কগুলোয় ক্রমশ বাড়তে থাকা দূরত্ব কখনোই কমাতে পারেননি তিন – বিচ্ছিন্ন একটি জীবনে সেই উদ্বাসনের যন্ত্রণাকে ভুলতে নিজের শরীরের অংশ দিয়ে সৃষ্টি করার চেষ্টা করেন তার শিল্পকর্ম। সেই শূন্যস্থানটাকে পূর্ণ করার চেষ্টাই তার শিল্পকর্ম। আবারো নতুন করে নিজের আত্মপরিচয় খোঁজার প্রচেষ্টা এই বিশাল বিশ্বে- সেই পার্চমেন্টের প্যালিমসেস্ট এর মত যেখানে পুরোনো সব লেখা মুছে আবারো নতুন করে লেখা হয় নতুন শব্দমালা।

13_asma_sultana_kokoro_2016_artistshair_4x4inch
বিশুদ্ধ সুন্দরকে অনুসরণ করেই একদিন আকাশের ওপারে অন্য আকাশের ঠিকানায় দেশান্তরী হয়েছেন, স্থায়ী হবার জন্য এখনও যে যাযাবর জীবন খুঁজে পায়নি উর্বর মাটি। চলমান জীবনের সবটুকু নিংড়ে দিয়েছেন তার শিল্পে, নিজের জীবনটাকেই একান্ত নিজের করে নিয়ে সৃষ্টিতে আত্মমগ্ন হয়েছেন, যেখানে নিজের অস্তিত্বের মানচিত্রে জায়গা পেয়েছে শিল্পীর যাপিত জীবনের অসংখ্য অভিজ্ঞতার স্মারক। নিজের আত্মপরিচয় খোঁজার প্রত্যয়ে তার শরীরেরই অনন্য অংশ, হাতের আঙ্গুলের ছাপ প্রতিস্থাপিত করে তুলিকে, মাথার চুল জায়গা নেয় সুতোর – প্রতীকীরুপে বাঙ্ময় হয়ে উঠেছে শিল্পীর জীবনের কোলাজে। অবশ্যই এই মহাকাব্য এখনও পরিণতি পায়নি, শিল্পী মনে করিয়ে দেন; আর তার সেই মহাকাব্যকে বুঝতে আমাদের সচেতন স্মৃতিতে ধরে রাখতে হবে মহাকাব্যের সূচনাটিকে, আর অতীত, অতীত হবার কারণে আমাদের কাছে অস্পৃশ্য রয়ে যায় চিরকালই – সময়ের ধ্বংসলীলায় অবশিষ্টাংশগুলোই কেবল টিকে থাকে সেই অভিজ্ঞতাগুলোকে পুনঃসৃষ্টি করার জন্য। স্মৃতির সেই কথোপকথনের অনুরণন শিল্পীর সৃষ্টিতে প্রাণ খুঁজে পায়, আর এটাই শিল্পীর আত্মপরিচয়ের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অনুভব – যে পরিচয় তাকে সাহসী করেছে আর শক্তি যুগিয়েছে একজন শিল্পী আর মুক্তমনের মানুষ হিসাবে নিজের নিয়তি পুনর্লিখনে।


কাজী মাহবুব হাসান | লেখক ও অনুবাদক  ( শিরোনামটির অনুপ্রেরণা কবি রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহর ‘হারানো আঙুল’ কবিতার একটি পংক্তি )
টরোন্টো, ৩০ ডিসেম্বর, ২০১৬

img_0009