
এমন মনে হওয়াটা অস্বাভাবিক নয়, ‘সত্য’ এমন এক রহস্যে মোড়া মুক্তো দানার মতো, পৃথিবী সব সময়ই সেই বৃত্তের চারপাশে আবর্তিত হতে থাকে! একমিনিট আগেও ঘটে যাওয়া ঘটনার সত্যতা যাচাই করতে আমাদের শার্লক হোমসের মত অতিবুদ্ধিমান মানুষদের প্রয়োজন হয়। যাদের আমরা দেবতা বলে পুজা করি তাদেরও চরিত্রের কত কলূষিত দিক আছে, আর যাদের ঘৃণ্য বলে জানি তাদের মাঝেও থাকতে পারে অনেক সুপ্ত প্রতিভা।
হিটলারকে কে না চেনে ? যারা চেনে তারা তো জানেই, যারা চেনেনা তারাও জানে যে হিটলার এক ঘৃণার নাম। পৃথিবীর ইতিহাসে সবথেকে ঘৃণিত ব্যাক্তিত্ব। অভিধানে এমন কোনো শব্দ নেই যাতে হিটলারের নৃশংসতার ইতিহাস বণর্না করা সম্ভব।
এডল্ফ হিটলারের জন্ম হয়েছিল এমন এক দেশে যেখানে সুর ভেসে বেড়াই আকাশে বাতাসে ; অস্ট্রিয়া যার নাম। আমরা জানি অস্ট্রিয়াতে জন্মগ্রহণ করেছেন, অনেক প্রতিভাবানদের মানুষ; সুরকার মোৎজার্ট , সুবার্ট, বাখ থেকে শুরু করে বিখ্যাত মনোবিজ্ঞানী সিগমন্ড ফ্রয়েড , শিল্পী গুস্তাভ ক্লিম্ট বা ইগন সিলাহ এবং আরো অনেকে।

এডল্ফ হিটলারের জন্ম বসন্তের এক সন্ধ্যায় এক সরাইখানাতে বাবামায়ের ছয় সন্তানের মধ্যে ৪র্থ সন্তান হিটলার। বুকে তার মহৎ এক স্বপ্ন , বড় হয়ে সে শিল্পী হবে। একজন মানুষের স্বপ্নই পারে, তাকে তার গন্তব্যে পৌঁছে দিতে। স্বপ্নহীন মানুষ যেনো ডানা কাটা পাখি, মুখ থুবড়ে পড়ে থাকে। আর প্রতিকুলতা থেকে নিজেকে বাচাঁতে দিনে দিনে হিংস্র হয়ে ওঠে। আমরা যদি না পারি কারো স্বপ্নকে ডানা দিতে, না হলে যেনো কারো স্বপ্নকে হত্যা না করি। কারো জন্য হয়তো ঔ স্বপ্নটুকুই বেঁচে থাকার শেষ সম্বল। আমরা যদি নিজেরা নিজের স্বপ্নকেই বেড়ে উঠতে দেই, তাহলে অন্যের স্বপ্নকেও মূল্য দিতে শিখবো। স্বপ্নাহত মানুষ যেনো অন্ধ দৈত্যের সমান।
এমন এক স্বপ্ন বুকে নিয়ে ধীরে ধীরে বেড়ে উঠছিলো হিটলার আর যে কোনো শিশুর মতোই। শৈশবে আর দশটা সাধারণ ছেলের মতোই, বাবাকে ক্ষেতের কাজে ও মৌমাছি চাষে সাহায্য করতো, খেলতো কাউবয় ও ইন্ডিয়ান। ক্যাথলিক স্কুলের নিয়মিত ছাত্র ছিলো সে। গানের প্রশিক্ষণ নিতো নিয়মিত, এমনকি চার্চে গানও গাইতো। জীবন চলছিলো স্বাভাবিক গতিতেই।

নিয়তির নিমর্ম পরিহাস বদলে দিতে থাকে পটভূমি, ধীরে ধীরে ভেঙ্গে যায় হিটলারের স্বপ্ন এক এক করে। ১৯০০ সালে ছোট ভাই এডমুন্ড‘র মৃত্যূতে এমনভাবে ভেঙ্গে পড়লো হিটলার, যে ছেলে স্কুলে মনোযোগী ছিলো, ছিলো আত্মবিশ্বাসী, মিশুক , বিভিন্ন বিনোদন মূলক কাজে জড়িত রেখেছিলো নিজেকে, সে হয়ে পড়লো একা ও খিটখিটে স্বভাবের। সারাক্ষণ বাবার সাথে সংঘাত শুরু হলো, বিবাদে জড়িয়ে পড়তো শিক্ষকদের সাথেও। সেই সময় হিটলারের মায়ের সাথে হিটলারের বাবার সম্পর্ক ও ভালো যাচ্ছিলো না।
১৯০০ সালে হিটলার যখন ক্লাসিক্যাল হাই স্কুলে আর্ট শিক্ষার জন্য ভর্তি হতে চেয়েছিল, বাবা তাকে জোর পূর্বক টেকনিক্যাল হাই স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেয়। তিক্ততায় ভরে যায় হিটলারের মন, হিটলার হয়ে ওঠে আরো বেশী বিদ্রোহী। হিটলারের লেখা স্মৃতিচারণ- ‘ My Struggle‘ এ হিটলার আক্ষেপ করে বলেছিলো : ” what little progress I was making at the technical school he would let me devote myself to the happiness I dreamed of.”
এভাবে হিটলারের পিতার প্রতি ঘৃণা থেকে, তীব্র ঘৃণা জমে উঠতে থাকে অস্ট্রিয়ার রাজতন্ত্রের প্রতি। ১৯০৩ সালে বাবার মৃত্যূতে আরো বেপরোয়া হয়ে ওঠে হিটলার। স্কুলে কোনো ভাবেই মনোযোগ না বসাতে পেরে, ও নানা ঘটনার জন্ম দিয়ে শেষে স্কুল থেকে বহিষ্কৃত হয়। এরপরেও প্রিয় মায়ের সঙ্গ সহ শিল্পী হবার স্বপ্ন নিয়ে যখন বেড়ে উঠছিলো কিশোর হিটলার তখন ১৯০৭ সালে ক্যানসারে মায়ের মৃত্যুতে বিদ্ধস্ত হিটলার আরো মানসিক ভাবে ভেঙ্গে পড়ে।

এই ১৯০৭ সালে এ্যাকাডেমি ওফ ফাইন আর্টস ভিয়েনাতে হিটলার ভর্তির জন্য চেষ্টা করে বিফল হয়। পরের বছর আরো বেশী কঠিন পরিশ্রম করে সফল হওয়ার জন্য, কিন্তু ভাগ্যদেবী এবারো সুপ্রসন্ন হলো না ; হিটলারকে বাতিল করে বলে দেয়া হলো “unfitness for painting” !
হিটলার তার কাজে স্থাপত্যেকে সুন্দর ভাবে ফুটিয়ে তুলতে পারতো, পরিপ্রেক্ষিতেও দক্ষতা কম ছিলো না, আর যেকোনো অপেশাদারী শিল্পীর মতোই সে শহরের ল্যান্ডস্কেপ দিয়ে শুরু করে ছবি আকাঁ। যদিও মনে করা হতো, হিটলারের মধ্যে বিখ্যাত শিল্পী হবার তেমন কোনো সম্ভাবনা ছিলনা; তাকে উপদেশ দেয়া হলো, স্থাপত্যে পড়ার চেষ্টা করে দেখলে হয়তো কিছু করতে পারে। আশাহত হয়ে বলেছিলো হিটলার : ‘In a few days I myself knew that I should some day become an architect. To be sure, it was an incredibly hard road; for the studies I had neglected out of spite at the Realschule were sorely needed. One could not attend the Academy’s architectural school without having attended the building school at the Technic, and the latter required a high-school degree. I had none of all this. The fulfillment of my artistic dream seemed physically impossible’.
হিটলারের বর্ণনায় সেই সময়টা ছিলো তার জীবনের সব থেকে দুঃসময় । তাকে ‘হোমলেস’ আশ্রয়ে থাকতে হয়েছে।এতিমদের জন্য ভাতা ও পরে এক আত্মীয়ার কাছ থেকে কিছু অর্থ , এই মিলিয়ে চলতে হয়েছে কষ্টকরে। সে সময় হিটলার ছবি একেঁ বিক্রি করতে চেষ্টা করে পর্যটকদের কাছে। সবাই জানতো তাকে উঠতি শিল্পী হিসেবে , যে জীবিকার তাগিদে নিজের আকাঁ ছবি বিক্রি করতো পথে ঘাটে।

সেই এতিমভাতা থেকে হিটলার বোন পওলাকে ভাগ দিতো। এই ছোট বোন পওলা হিটলার আর সব ভাইবোনদের মাঝে বেঁচে ছিলো শেষ পযর্ন্ত। বাকিরা সবাই অল্প বয়সেই মারা যায়। পওলাকে হিটলার বেচেঁ থাকার আগ পর্যন্ত অথনৈতিকভাবে সাহায্যে করে গেছে। ১৯৬০ সালে পওলা মারা যায়, হিটলারের মৃত্যুর পনেরো বছর পরে। ১৯৪৫ এর ৩০ এপ্রিল, তার জন্মদিনের ঠিক দশদিন পরে ৫৫ বছর বয়সে, এক করুণ পরাজয়ের মুহূর্তে আত্মহত্যা করে, বিশ্বের কুখ্যাত স্বৈরাচারী নেতা।
১৮৮৯ সালে ২০ এপ্রিল একটি শিশু, এই পৃথিবীতে আলোর মুখ দেখেছিলো, যার নামের অর্থ ‘রাখাল’ বা ‘যে কুড়ে ঘরে বাস করে’; আর যে কোনো শিশুর মতোই ছিলো সে খুব সাধারণ। এক স্বপ্নভরা চোখ নিয়ে এসেছিলো সে এই পৃথিবীতে, নিয়তির নির্মম পরিহাসে তার স্বপ্ন ভেঙ্গে চূর হয়ে গেলো তার, সে স্বপ্ন ছিলো আর কিছুই না শুধুই একজন শিল্পী হবার ।
পরবর্তীতে পওলা হিটলার ব্রিটিশ টিভিকে দেয়া সাক্ষাতকারে নিজের ভাই সম্পর্কে বলেছিলো, হিটলারের ক্রম উত্থান তাকে চিন্তিত করে তুলছিলো। পওলার মতে হিটলার যদি স্থপতি হওয়ার স্বপ্নকে অনুসরন করতো তাহলে পৃথিবী রক্ষা পেতো অনেক দুঃশ্চিন্তা থেকে ।

এপ্রিল ২০১১, টরোন্টো