দ্যা স্ক্রিম ; মুন্কের বিশেষ প্রদর্শনী, মিউজিয়াম অব মর্ডান আর্ট , নিউ ইয়র্ক , ২০১২
ছবি : আসমা সুলতানা
পঞ্চইন্দ্রিয় দিয়ে আমরা যা কিছু অনুভব করি, তার সব কিছুই আবার পঞ্চইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে প্রকাশ করে থাকি । যখন জীবনের কিছু ঘটনাকে আমরা প্রকাশ করতে অক্ষম হই, আশ্রয় নেই এমন এক ভাষার যা হয়তো সম্পুর্ন নিজস্ব বা ব্যাক্তিগত । কেও তুলে নেয় রঙতুলি , কেও বা কলম, কেও বা সুর। এরপরেও অনেক অব্যক্ত ভাষা ডানা মেলে দেয় আামদের অবচেতন মনের আকাশে । ভীড় করে সব স্মৃতি স্বপ্ন ও দু:স্বপ্নের শরীর নিয়ে । এমন এক দু:স্বপ্নের শিল্পরুপ এডভার্ড মুন্কের ‘দ্যা স্ক্রিম ’ নরওয়েজিান ভাষায় যাকে বলে স্ক্রিক(Skrik )।
’দ্যা স্ক্রিম’ বা ’দ্যা স্ক্রিম অব নেচার’ শিল্পর্কমটি পৃথিবীর সবচেয়ে বিখ্যাত ও মুল্যবান শিল্পকর্ম গুলোর মধ্যে একটি । যে কোনো শিল্পপ্রেমিকের মুল শিল্পকর্মটি দেখবার বাসনা থাকারই কথা এবং সেকারনে তাকে যদি সুদুর উত্তর ইউরোপের দেশ নরওয়ে তে পাড়ি জমাতে হয় তবুও । তেমনই একটা বাসনা মনের ভেতরে পুষে রেখেছিলাম অনেক দিন আগে থেকেই। গত নভেম্বরে যখন মিউজিয়াম অব মর্ডান আর্ট, নিউ ইয়র্ক দেখতে যাওয়ার সুযোগ হলো , তখনও জানা ছিলো না যে সেখানে ছয় মাসের ( অক্টোবর ২০১২ – মার্চ ২০১৩ ) জন্য শিল্পী মুন্ক এর শিল্পকর্মের একটি বিশেষ প্রদর্শনী চলছে। আর আমারো সৌভাগ্য হলো গভীর বিস্ময় নিয়ে প্রিয় মুন্ক এর কাজ দেখার ।
পৃথিবীর সব বিখ্যাত সুপরিচিত পেইন্টিংগুলোকে কিন্তু বড়সড় আকারের হতে দেখা যায় না ; যেমন ভিন্চির মোনা লিসা, ভ্যান গো এর সুর্যমুখি, ঠিক তেমনি এডভার্ড মুন্কের ‘দ্যা স্ক্রিম’ ।
এসব শিল্পকর্ম আকারকে বলা যেতে পারে মধ্যম, বেশির ভাগই যে কোনো স্বাভাবিক প্রতিকৃতির পেইন্টিং এর আকারের মতো ( ২৪ বাই ৩০ ইন্চি )।
বোধ কারি স্বল্পপরিসরে আঁকা হয় বলে তারা বেশ আবেগঘন হয়, যা কিনা শিল্পকর্মটি দর্শকের মনে জায়গা করে নিতে পারে সহজে । জায়গা করে নিতে পারে দর্শকের স্মৃতিতে । হয়তো কারো আজ আর অজানা নেই যে, মুন্কের এই বিশেষ শিল্পকর্মটি কিন্তু শিল্প চৌর্যবৃত্তির সাথে জড়িত এমন কারো কাছেও বেশ লোভনীয় বস্তু বটে।
এডভার্ড মুন্ক :
শিল্পী এডভার্ড মুন্ক (Edvard Munch) এর জন্ম ১৮৬৩ সালের বারো ডিসেম্বর, নরওয়ের লোটেন এর আডাল্সব্রুক গ্রামে (Ådalsbruk in Løten ) এবং বেশ দীর্ঘ একটি জীবন শেষে তার মৃত্যু হয় ১৯৪৪ সালে,যখন তার বয়স আশি। মুন্ক মর্ডান আর্টের প্রধান শিল্পীদের মধ্যে অন্যতম ও স্বতন্ত্র একজন শিল্পী । শৈশব থেকে রোগ, শোক, দু:খ, বেদনা তাকে ঠেলে দিয়েছিল সৃষ্টির জগতে। প্রিয় মাকে হারিয়েছেন মাত্র পাঁচ বছর বয়সে,এরপরে মাত্র পনেরো বছর বয়সী বড় বোনকে হারান তার তের বছর বয়সে।
তার বাবা ছিলেন গোড়া ধার্মিক । ঘরে ছিল তার বাবার কড়া অনুশাসন, ছোট বোনের মানসিক অসুস্থতা, এরপর ছোট ভাইয়ের মৃত্যু এবং অত:পর বাবার মৃত্যু, তারসাথে যুক্ত হয় প্রথম বিশ্বযুদ্ধের বিভৎসতা, পরে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় নাৎসী অধিকৃত নরওয়েতেই তার শিল্পকর্মের প্রতি নাৎসিদের অবহেলা ও অত্যাচার । সব মিলিয়ে মুন্ক জীবনের সেই অন্ধকার গুহার একজন বাসিন্দা , যেখানে সুর্যের আলো এসেছে খুব ক্ষীন আর বিচ্ছিন্ন ভাবে । মুন্কের শিল্পকর্মে সেই অন্ধকারেরই দেখা মেলে সুসজ্জিত ও সুশৃঙ্খল ভাবে । মুন্কের শিল্পকলায় হতাশাই প্রধান উপাদান, সাথে মৃত্যু , ভয়, রোগ –শোক, যৌনতা, দু:খ-বেদনা, দৈহিক ও মানসিক যন্ত্রনা, একাকিত্বতা ও বিচ্ছেদ; তিনি তার অস্তিত্বের তীব্র অন্তর্দহনকে প্রকাশ করতে সক্ষম হয়েছিলেন নজিরবীহিন নানা রুপকের অনন্যতায়।
মুন্ক অত্যন্ত সফলভাবে তার কাজে ফুটিয়ে তুলেছিলেন তাঁর গভীর মনোজাগতিক দৃশ্যপটকে। দর্শকের বুঝতে কোনো অসুবিধা হয় না , যে শিল্পী কিভাবে জীবনটাকে কাটিয়ে গেছেন । অভিব্যাক্তিময় কাজ গুলোতে তার শৈশব অভিজ্ঞতা ও জীবনের বিভিন্ন সময়ের আর পর্যায়ের অভিজ্ঞতাগুলোই ফুটে উঠেছে । তার জীবনে খুব অল্পই ছিলো সুখময় ।
শিল্পকলায় মাথার খুলিকে সাধারনত দেখানো হয় মৃতু বা শোকের প্রতীক হিসেবে । মুন্কের কাজে তেমন কোনো প্রচলিত, বহু ব্যবহৃত সিম্বল বা প্রতীকের ব্যবহার নেই ঠিকই, তবে তার ক্যানভাসের দৃশ্যপটে কংকাল সদৃশ ফিগারগুলোই যেনো জীবন্ত শোককে প্রকাশ করছে। তাদের দেখলে মনে হয় না রক্ত মাংসের মানুষ বা মৃত কংকাল । বরং এ দুটোর মাঝামাঝি কোনো একটা প্রানী। অনেকটাই যেন এলিয়েন সদৃশ,কোটরাগত চক্ষু ও চামড়া সর্বস্ব শরীরের কারনে তাদেরকে ভীনগ্রহের বা অপার্থিব বলেই মনে হয় ।
মুন্ক এর কাজকে অভিব্যাক্তিময় ও প্রতিকী বলা যায় অনায়াসে । যদিও জার্মান বিমুর্ত-অভিব্যাক্তিবাদের ঘরানার মধ্যে পড়ে তাঁর কাজ । তবে তাঁর কাজকে পুরোপুারি বিমুর্ত অভিব্যাক্তিবাদ বলা যাবে না । ফিগারেটিভ সেমি-এবস্ট্রাক্ট এক্সপ্রেশনিজম বা আধা-বিমুর্ত -অভিব্যাক্তিবাদ বলা যেত পারে । তাতে মনোজাগতিক অভিব্যাক্তি এক নতুন আর অনন্য মাত্রা যোগ করেছে । যদিও মুন্কের কাজ কে প্রভাবিত করেছে , ফরাসী ইম্প্রেশনিস্টরা ও, শিল্পী পল গঁগ্যা ও ভিনসেন্ট ভ্যান গো তাদের মধ্যে অন্যতম ।
নিজের কাজ সম্পর্কে মুঙ্কের নিজের ভাষ্য বলছে.. “ শিল্পী লিওনার্দো দা ভিন্চি, যেমন মানব মৃতদেহকে পরীক্ষা নীরিক্ষা করেছেন ব্যবচ্ছেদের মাধ্যমে আর আমি ব্যাবচ্ছেদ করেছি মানুষে মন কে , তার গভীরের অন্তর্গত স্বত্তাকে ।”
দ্যা স্ক্রিম :
লেখার শুরুতে মুন্কের যে শিল্পকর্মটির কথা উল্লেখ করেছি সেটি মুন্ক এর আঁকা প্রধান চারটি ভার্সনের একটি , যা ১৮৮৫ সালে প্যাস্টেলে আঁকা হয়। ২০১২ সালের মে মাসে বিখ্যাত অকশন হাউজ সথবে আয়োজিত ইম্প্রেশন্স্টি এবং মর্ডান আর্টের নীলামে -বিক্রি করা হয় প্রায় ১২০ মিলিয়ন ডলারে । দ্যা স্ক্রিম শিল্পকর্মটি পৃথিবীর শিল্পকলার ইতিহাসে আইকনিক শিল্পকর্মগুলোর অন্যতম একটি । মিউজিয়াম অব মর্ডান আর্ট নিউ ইয়র্ক , ছয় মাসব্যাপী যে প্রদর্শনীটির আয়োজন করেছে সেখানে প্যাস্টেলে আঁকা এই ভার্সনটি সহ আরো রয়েছে একটা লিথোগ্রাফ ভার্সন ।
দ্যা স্ক্রিম – এর মুল চারটি ভার্সন এঁকেছিলেন মুঙ্ক। এর মধ্যে প্রধানটি ছিল তেল রঙে আঁকা । টেম্পেরাতে আঁকা র্ভাসনটি রয়েছে মুন্ক মিউজিয়াম (১৯১০) এ । আরো একটি ১৮৯৩ সালের আঁকা, রয়েছে মুন্ক মিউজিয়ামে । প্যাস্টেলে আঁকা (১৮৮৩) আরেকটি রয়েছে ন্যাশনাল গ্যালারী অব অসলো, নরওয়েতে। ১৮৯৫ সালে মুন্ক তাঁর প্রিয় মাস্টারপিসটির একটি গ্রাফিক ভার্সন সৃষ্টি করেন ।
মুন্কের লেখায় বা কবিতায় মুন্ক দ্যা স্ক্রিম – সম্পর্কে বর্ণনা করেছেন এভাবে:
“আমি (ব্রীজের উপর দিয়ে )হেটে যাচ্ছিলাম (দুই বন্ধু সহ ), সুর্য অস্ত যাচ্ছিলো , হঠাৎ মনে হলো আকাশটা রক্ত লাল হয়ে গেলো । আমি দাড়িয়ে গেলাম, ভয়ে বা অসুস্হতায় । মনে হলো আমার শরীর কাঁপছে , মনে হলো এক দীর্ঘ বিকট চিৎকারে ভেসে যাচ্ছে চারিদিক , সেই চিৎকারে বিছিদ্র হলো প্রকৃতি।”
দ্যা স্ক্রিম এর মুল ফিগারটিকে পার্থিব বলে মনে হয় না । প্রায় কংকাল সদৃশ্য ফিগারটিতে কিছু সহজ রেখার মাধ্যমে এর দুবর্লতাকে বা শক্তিহীনতাকে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। দুরের ফিগার দুটোকে মুল ফিগারটির চেয়ে মনে হয় বেশী বাস্তব ও সাবলীল, এগুলো মুন্কের বন্ধুদের অবয়ব হতে পারে । এ ফিগারগুলো থেকে প্রধান ফিগারটির দুরত্ব, বর্ননা করে মুন্কের একাকিত্বতা বা বিচ্ছিন্নতাকে । এখানে দেখা যায়, প্রকৃতির এই অস্বাভাকিতায়, সহজ স্বাভাবিক ভঙ্গিতে হেটে যাওয়া ফিগারগুলোতে, যেনো কোনো বিকার নেই । বিকট চিৎকার সামনের ফিগারটিকে যেভাবে প্রবাবিত করছে,তাদেরকে সেভাবে প্রভাবিত করছে না।
দ্যা স্ক্রিম এর এই অভিজ্ঞতাটি তাঁর হয়েছিল নরওয়ের অসলো শহরে দক্ষিন পুর্বে অবস্থিত ইকেবার্গ ( Ekeberg) পাহাড়ের উপরের একটি রাস্তায়, স্থানীয়দের কাছে যা পরিচিত Valhallveien নামে; এর উপর থেকেই পুরো অসলো শহরটাকে এক ঝলকে দেখা যায়; পাহাড়ের উপর দিয়ে রেলিং সহ আকাবাকা হয়ে উঠে যাওয়া এই রাস্তাটি অসলো (মুঙ্কের সেই সময় অসলোর নাম ছিল ক্রিষ্টিয়ানা, পরে যা পরিবর্তন করা হয়) বাসীদের কাছে বেশ জনপ্রিয় । মুন্ক তাঁর আর সব কাজের মতো দ্যা স্ক্রিম এও নিজের মনোজগতিক ও শারীরিক গভীরতম অনুভুতিকে প্রকাশ করেছেন । আাকাশের লাল গোলাপী হলদেটে রঙে পরাবাস্তবতার আভাস। দুরে নীচে নদীর মতো বাকানো গভীর গাঢ় নীলচে কালো — লাল-বাদামী-নীল -সবুজাভ মিশ্র রঙের বিমুর্ত প্রকৃতি বা ভুদৃশ্য । চেনার উপায় নেই এটি মুন্কের চির চেনা সেই রেলিং দিয়ে ঘেরা পথ, যেখান থেকে পুরো শহরটাকে দেখা যায়। এই ইকেবার্গ পাহাড়ের আশেপাশের প্রকৃতির সাথে জড়িয়ে আছে মুন্কের অনেক স্মৃতি ও অভিজ্ঞতা ।
উপরে ব্রীজে তিনটি মানব মুর্তি , নীচে বিমুর্ত প্রকৃতি । মনে হয় চির চেনা জগৎ যেভাবে বিমুর্তভাবে দেখা দেয় স্বপ্নের ভেতর। গভীর ঘুমে দু:স্বপ্নের ভেতর যেমন চিৎকার করলে যেমন কেউ শুনতে পায়না , হৃদয় চিরে বের হয়ে আসা চিৎকারকে শরীরের ভিতরেই শুষে নিতে হয়। চিত্রে প্রধান ফিগারটিকে ঘিরে যেনো প্রকৃতির চিৎকার চারিদিকে । ফিগারটি চিৎকার করাবার চেষ্টা করছে কিন্তু কেউ তা শুনতে পারছে না । ঠিক তেমন এক অনুভুতিকে প্রকাশ করছেন মুন্ক তার এই শিল্পকর্মটিতে ।
মুন্কের প্রকাশভঙ্গি তাঁর শিল্পকর্মের মতোই আজো অনবদ্য ; “শিল্পকলা , সাহিত্য, সংগীতের সবকিছুই অবশ্যই শিল্পীর হৃদয় নিসৃত রক্ত থেকে সৃষ্টি হতে হবে । শিল্পকলা হলো শিল্পীর নিজের হৃদয়েরই রক্ত ক্ষরণ।”
“ From my rotting body,
flowers shall grow
and I am in them
and that is eternity.”
Edvard Munch