
Art of Peace:
২০০৬ সালের শেষের এক বিকেলে। শরৎ কালের লন্ডন যেন নীল আকাশের তলে হারিয়ে যাওয়া, ম্যাগনোলিয়া রঙের রোদের শহর। হারিয়ে যাবো বলে সেই শরতের বিকেলে, হাটতে হাটতে আমিও পা বাড়াই লন্ডনের পাথরশক্ত রাজপথে। সবুজ রঙের পাতায় সবে হলদেটে আভা। বাতাসে ভরে আছে পাতাদের আর শেষ গ্রীষ্মের শুকনো ফুলের ঘ্রাণ। আমি পাতাল রেল থেকে বের হয়ে, এগিয়ে যাই গ্রেট রাসেল স্ট্রিটের দিকে। প্রায়ই বিশেষ কোনো উদ্দেশ্য ছাড়াই আমি ব্রিটিশ মিউজিয়ামে ঘুরে দেখতে যেতাম। কিন্তু সেইদিন ব্রিটিশ মিউজিয়ামে আমার জন্য অপেক্ষা করছিল একটি অসাধারন বিস্ময়।
ব্রিটিশ মিউজিয়ামের উচুঁ সিড়ি বেয়ে উঠে, প্রধান দরজা পার হয়ে ঢুকতেই যে করিডোর, তার ডান পাশে ছোট্ট একটা রুম, সাধারনত অস্হায়ী প্রদর্শনীগুলো চলে যেখানে; সেই ৩ নম্বর রুমে বাংলা অক্ষরে বড় বড় করে, কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের (৭ মে ১৮৬১-৭ অগাস্ট ১৯৪১) কবিতা থেকে নেয়া পংক্তিগুলো দেখে, আমি অবাক আর বিস্মিত হলাম;অপার্থিব একটি আবেগ আমাকে আপ্লুত করলো। নিজের মাতৃভাষাকে এভাবে, এত সুন্দর ভাবে মর্যাদার সাথে দেখবো ভাবিনি কখোনো, গর্বে আমি শিহরিত হলাম। চোখ ভিজে এলো জলে,কবিগুরুর প্রতি শ্রদ্ধায়। মনে হলো একমাত্র কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পক্ষেই সম্ভব , আমাদের প্রিয় মাতৃভাষাকে তার যোগ্যতম মর্যাদার আসনে আসীন করা, সারা বিশ্বের মানুষের কাছে পৌছে দেয়া, আমাদের বাংলাভাষার সৌন্দর্য ও মহিমা। ব্রিটিশ মিউজিয়ামের সাদা দেয়ালে কলো কালিতে সরাসরি লেখা সুন্দর ক্যালিগ্রাফির মাধ্যমে, কবি গুরুর কবিতার অক্ষর গুলো যেনো জ্বলছিলো সেদিন, নক্ষত্রের মতো শরতের বিকেলে। ঐ কালো অক্ষরগুলোই যেনো শিল্পকর্মের মতো শোভা পাচ্ছিলো মিউজিয়ামের সাদা দেয়ালে দেয়ালে। আমি নিয়ম ভঙ্গ করে হাত দিয়ে একটু ছুঁয়ে দেখলাম।
ব্রিটিশ মিউজিয়ামের বিশেষত্ব, প্রাচীন ঐতিহ্যকে তুলে ধরা , সাধারনতঃ আধুনিক শিল্পকর্ম প্রদর্শনী হয়না। সেদিক থেকেও এই প্রদর্শনীটি ছিলো নিঃসন্দেহে একটি ব্যতিক্রম। প্রদর্শনীতে ছিলো মূলত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কিছু ফটোগ্রাফ, সত্যজিৎ রায়ের তৈরী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে নিয়ে স্বল্পদৈর্ঘের একটি প্রমান্য চিত্র ও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আকাঁ কয়েকটি স্কেচ ও ড্রইং। পরে জেনেছি , সেগুলো আসলে ব্রিটিশ মিউজিয়ামকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নিজেই দান করেছিলেন। তবে এটাই ছিলো, ব্রিটিশ মিউজিয়ামে পক্ষ থেকে প্রথমবারের মতো রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সেই সব মূল্যবান চিত্রকর্মের প্রদর্শনী। প্রদর্শনীতে নানা বর্নের মানুষের ভীড়। সবাই দেখছে দু’চোখ ভরে, মুগ্ধ হচ্ছে, আমি দেখছি। কারণ, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তো আর নতুন কোনো বিষয় না পশ্চিমের কাছে। ’Art of Peace’ নামে কবিগুরুর সেই প্রদর্শনীটিও জমে উঠেছিলো, ব্রিটিশ মিউজিয়ামের স্হায়ী সব প্রাচীন ঐতিহ্যের প্রদর্শনীর পাশাপাশি। আমি যেসব খুব অল্প কিছু কারনে নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে করি,এই দিনটার প্রাপ্তি, তাদের মধ্যে অন্যতম ।

সুন্দর তুমি চক্ষু ভরিয়া এনেছো অশ্রুজল (রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ) :
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শিল্পকলার সাথে যখন আমার প্রথম পরিচয় ঘটে, আমার বয়স তখন ৬ অথবা ৭ বছর। বাবার কাজের সুবাদে, প্রায় বছর দেড়েকের জন্য, কুষ্টিয়া থাকতে হয়ে ছিলো আমাদের। আমরা প্রায়ই দলবল বেধে বেড়াতে যেতাম শিলাইদহ কুঠিবাড়ীতে। আমি তখন শুধু কবিগুরুর নামটা জানি, বা লিখতে পারি, জানি কিছু কবিতা ও ছড়া। বাবা শুধু একটানে রবীন্দ্রনাথের অবয়ব এঁকে দেখাতেন সেই সময়গুলোতে। জানি উনি এতবড় মাপের মানুষ যে, আমার মতো ছোট্ট বালিকার পক্ষে ধারণা করা প্রায় অসম্ভব ! আমি শিলাইদহের বকুলতলায়, দিঘির ঘাটে, বাগানে, খেলাধুলা করতাম। দিনশেষে ধুলা মাখা শরীরে আমরা পদ্মা নদী পাড়ি দিয়ে শহরে ফিরে আসতাম আবার। তখন থেকেই আমার পরিচয় কবিগুরুর চিত্রকলার সাথে। সে সব চিত্রকলা বুঝি আর নাই বুঝি, মনে আছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সেই সাজানো কুঠিবাড়ী ; শুল্ক আদায়ের টেবিল, তাঁর ব্যবহৃত স্পীডবোট, কবিগুরুর পালঙ্ক, সব কিছু রাখা ছিলো সুন্দর ভাবে আর দেয়ালে শোভা পাচ্ছিলো সব শিল্পকর্ম গুলো। আমি ধন্য আমার এই দুই চোখে আমি সেগুলো দেখেছি, আমার শৈশব থেকে।
১৯৯৯-২০০০ এর দিকে,আবার বাবা বদলি হলেন,আমার প্রিয় কুষ্টিয়ায়। আমি তখন চারুকলাতে সম্ভবত ৩য় বর্ষে পড়ি (সব ধরনের জট সহ); নতুন ভাবে রবিঠাকুরের চিত্রকলা দর্শনকে সম্পূর্ন করতে পারবো, প্রানে যেনো খুশির জোয়ার এলো। আবার ছুটলাম কুঠিবাড়ীর দিকে, দেখলাম অন্য চোখে, পরিপূর্ন সে চোখ, মনও খুঁজে নিলো সুন্দরকে। আমাদের পাঠ্যপুস্তকে শিল্পকলার ইতিহাসের বিরাট একটা অংশ জুড়ে আছেন রবীন্দ্রনাথ। মনে পড়ে গেলো রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শেষের কবিতার আমার অতি প্রিয় লাইনটা “ সুন্দর,তুমি চক্ষু ভরিয়া এনেছো অশ্রুজল—” জানলাম চিরচেনাকে আবার নতুন রূপে, নতুন মহিমায়…
বাঙ্গালী জীবনে কোথায় নেই কবিগুরু ? রবীন্দ্রনাথ আমাদের জাতীয় সঙ্গীত থেকে শুরু করে বাঙালী জীবনের সব উৎসবে, সব আনন্দে, সব শোকে, মিশে আছেন তার সঙ্গীতে। ছেলে বেলায় পড়া আমাদের সেই ‘পাখি সব করে রব‘ থেকে শুরু করে ‘শেষের কবিতা’, ছোটগল্প, উপন্যাস ’সে‘—সে‘র কথা মনে পড়তেই মনে পড়লো , কবিগুরুর শেষ বয়সের এই উপন্যাসের প্রচ্ছদ তিনি নিজেই এঁকেছিলেন। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বহুমুখী প্রতিভার কথাআজ সবারই জানা, তিনি একাধারে কবি, লেখক, দার্শনিক, শিক্ষক, নাট্যকার, সুরস্রষ্টা, অভিনেতা, কন্ঠশিল্পী ও চিত্রশিল্পী।

‘অয়ম্ অহম্ ভো’—এই যে আমি এই” :
শিল্পী যামিনী রায়কে লেখা এক চিঠিতে কবি গুরু বলেছেন, “ছবি কি সেই প্রশ্নের উত্তর এই যে সে একটি নিশ্চিত প্রত্যক্ষ অস্তিত্বের সাক্ষী। …তার ভাল মন্দের আর কোনো যাচাই হতে পারে না। আর যা কিছু সে অবান্তর—অর্থাৎ যদি সে কোনোও নৈতিক বাণী আনে, তা উপরি দান। …চিত্রকর গান করে না, ধর্মকথা বলে না, চিত্রকরের চিত্র বলে ‘অয়ম্ অহম্ ভো’—এই যে আমি এই”।”
আমারা কবিগুরুর শিল্পকর্ম ও শিল্পী জীবন সম্পর্কে কিন্তু খুব একটা কিছু জানি না। তিনি যেমন নামে ’রবি’ তেমন আমাদের বাঙালী জীবনের অন্ধকার দূর করা র্সূয যেনো। তিনি সব কিছুতেই সবার প্রথম । আমাদের জন্য নোবেল পুরুষ্কার জয় করে আনলেন প্রথম (১৯১৩), তিনিই প্রথম অপশ্চিমী যিনি নোবেল পুরষ্কার জিতে নেন। তাঁর মাধ্যমেই পূর্ব ও পশ্চিমের মধ্যে সৌহার্দের সেতু বন্ধন তৈরী করেন। তিনি প্রথম ব্যক্তি যিনি উপমহাদেশ থেকে পশ্চিমের অনেকগুলো দেশ ভ্রমন করেন। ও সেই সময় পৃথিবীর সমস্ত মহান ব্যক্তিদের সাথে পরিচিত হতে পেরেছিলেন, এমনকি আমাদের সংস্কৃতিকে পরিচয় করিয়ে দেন সারা বিশ্বের দরবারে। তিনি একমাত্র কবি যার গান দুইটি দেশের জাতীয় সঙ্গীতের মযার্দা পেয়েছে। এবং তিনিই প্রথম চিত্রশিল্পী যার হাত ধরে আধুনিক শিল্পকলা এসেছে এই উপমহাদেশের শিল্পকলার রাজ্যে।
We are the music-makers . We are the dreamers of dreams. (Rabindranath Tagore) :
এই উপমহাদেশে আধুনিক শিল্পকলার ইতিহাসের যে শুরু জোড়াসাঁকোর ঠাকুর বাড়ীর উঠান থেকে, এ কথা বললে ভুল হবে না। জোড়াসাঁকোর ঠাকুর বাড়ীর তিন কৃতি সন্তান উপমহাদেশের শিল্পকলাকে সমৃদ্ধ করেছিলেন একটি আর্ন্তজাতিক ও আধুনিক মাত্রা যোগ করে। কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ভাতিজা অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও সহোদর গগেন্দ্রনাথ ঠাকুর ( বর্তমানের ভারতের প্রখ্যাত অভিনেত্রী শর্মিলা ঠাকুরের প্রপিতামহ )।
আমাদের উপমহাদেশের শিল্পকলার ইতিহাস হাজার বছরের। আর রাজনীতি বোধ করি সব কিছুরই নিয়ন্ত্রক ছিলো এই উপমহাদেশের ইতিহাসে। তাই যখন পশ্চিমে শিল্পকলার তার বিকাশের শিখরে, আমাদের সমাজ নিষ্পেষিত রাজদন্ডের ভারে। সেই রাজ দরবার ও মুঘল শাসন এর মহিমা পার করে এলো ব্রিটিশ শাসনামল, অভিষাপ বয়ে নাকি বর হয়ে ? মুঘল সাম্রাজ্যের পতনের পর শিল্পীরা ছড়িয়ে পড়েছিল উপমহাদেশের বিভিন্ন স্হানে, ব্রিটিশ রাজের আওতায় শুরু হয় শিল্পকলা শিক্ষা তার পুরাতন প্রথাগত পদ্ধতি বাদ দিয়ে কিছুটা আধুনিক হবার চেষ্টায় , শুরু হলো মৌলিকতা বিবর্জিত ইংরেজ শিল্পীদের শিল্পকর্ম নকল করার কাজ, যেমন: ভূদৃশ্য বা প্রতিকৃতি। একি বিষয়ের চর্বিতচর্বনে শিল্পীরা হয়ে উঠলেন ধৈয্যহীন।
ব্রিটিশ সরকারের নিয়োগ প্রাপ্ত আনের্স্ট বেনফিল্ড হ্যাভেল প্রথম উদ্যোগ নেন পশ্চিমা প্রভাববলয় মুক্ত ভারতীয় প্রাচীন ঘরানার শিল্পকলা শিক্ষার পত্তনে। শিল্পকলার ইতিহাসবিদ ও কলকাতা আর্ট কলেজের প্রধান শিক্ষক ও পরিচালক,ই. বি হ্যাভেল এর সঙ্গে ছিলেন শিল্পাচার্য নন্দলাল বসু । ই. বি হ্যাভেল ভারতীয় ধ্রুপদী শিল্পে মুগ্ধ হয়ে, অজন্তা ইলোরা সহ ভারতীয় দেশীয় শিল্পে উজ্জিবীত হয়ে, প্রথম অনুধাবন করেন যে, ভারতীয়দের নিজেদের যে ঐতিহ্য আছে তাকে নিয়েই সামনে আগাতে হবে। উপমহাদেশের মানুষগুলোকে বোঝানোর চেষ্টা করলেন ভারতীয় দেশীয় শিল্পকলার মর্ম, উদ্ভুদ্ধ করলেন ও প্রচেষ্টা চালালেন ভারতীয় শিল্পকলায় পুর্নজাগরনের। হ্যাভেলের আর্দশেই, জাতীয় চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে শিল্পাচার্য নন্দলাল বসু ভারতীয় ধ্রুপদী শিল্পকলার চর্চা করে গেছেন সারা জীবন।
ইউরোপ আধুনিক শিল্পকলার চারণভুমি হলেও ব্রিটিশদের চিত্রকলা তেমন উচ্চমানের না হওয়ায়, আমাদের শিল্পকলায় প্রভাব ফেলতে পারেনি সেভাবে। কিন্তু নতুন কিছুর প্রয়োজনীয়তা প্রাচীন ঐতিহ্য নির্ভর হ্যাভেল এর দিকনির্দেশনা ক্রমেই ম্লান হয়ে আসছিল। নতুন সেই পথের নির্দেশনা দিতেই যেন শিল্পী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তুলে নিলেন আপন কাধে সেই গুরু দায়িত্ব ; হাতে তুলে নিলেন কলম ও কালি না এবার আর লেখা নয় , লেখনিকে ছুটি দিয়ে শেষ বযসের ১০/১২ বছর কাটিয়ে দিলেন চিত্রকলা নিয়ে। পাশে পেলেন ভাতিজা অবনীন্দ্রনাথ ও গগেন্দ্রনাথকে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাষায় “ছবিই হলো আমার শেষ বয়সের প্রিয়া, তাই নেশার মত আমাকে পেয়ে বসেছে –।”

‘In Art, man reveals himself.’ (Rabindranath Tagore) :
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শেষ বয়সে, অনেকের মতে ৬০ বছর বা তার কিছু পরে, জীবনের শেষ ১০/১২ বছর, কবি গুরু ছবি এঁকে গিয়েছিলেন একটানা । রবীন্দ্রনাথের হঠাৎ এই উত্থানকে শিল্পী অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন Volcanic Irruption’ — “ভেবে দেখো, এত রং, এত রেখা, এত ভাব সঞ্চিত ছিল অন্তরের গুহায় যা সাহিত্যে কুলালো না, গান হলো না—শেষে ছবিতেও ফুটে বের হলো তবে ঠান্ডা।”
১৯২৪ সালে কাব্যগ্রন্হ ‘পূরবী’ র পান্ডুলিপির বুকে জন্ম হয় এই সব কাটা ছেড়াঁ আকিবুকি থেকে। ক্যালিগ্রাফির মতো সহজ সাবলীল ভঙ্গিমা থেকে শুরু করে, থেকে কাল্পনীক সব জীব-জন্তুর আকার আকঁতে শুরু করেন কবিতার পাতায়। পরে ১৯২৮ থেকে শেষপর্যন্ত একটানা, জীবনের শেষ মূহুর্ত পর্যন্ত । যদিও আমরা জানি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সেই শৈশব থেকেই ছবি আঁকতেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর বিভিন্ন লেখনিতে তা সুস্পষ্ট হয়ে ভাবে উল্লেখ করেছিলেন।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের চিত্রের বিষয়বস্তু ছিলো প্রধানত প্রতিকৃতি, নারী মুখ, অথবা পুরো নারী শরীরের বিমূর্ত বা অর্ধবিমূর্ত প্রকাশ। রহস্যাবৃত, রূপকের মত নারী-পুরুষের উপস্হিতিতে প্রকৃতির পটভূমিকায় কাল্পনিক এক স্বপ্নচিত্রের মতো। বিচিত্র সব অচেনা বা কাল্পনিক পাখি বা জীব-জন্তুর প্রতিকৃতি। অনেক সময় তা অলংকরনের মতো ফুটে ওঠে বা অনেক সময় মনে হয় পারসিয়ান নকশার আদলে দ্বিমাত্রিক ভাবে প্রকাশ পায়। রবিন্দ্রনাথের আঁকা ভূদৃশ্য তুলনা মূলক ভাবে কম। কিন্তু সব মিলিয়ে, কবিগুরুর শিল্পকর্মের সংখ্যা হাজারের উপরে। শিল্পী আচার্য নন্দলাল বসু বলেছেন– ‘ রবীন্দ্রনাথ গত দশ-বারো বছরের মধ্যেই যে সব ছবি এঁকেছেন, তার সংখ্যা গত পঞ্চাশ বছরে বাংলা দেশের সমস্ত নামকরা শিল্পীরা মিলে যত ছবি এঁকেছেন, তার চেয়েও বেশী।
ছবির নাম করনে কবি বেশ দ্বিধাদ্বন্দে পড়ে যেতেন। কবি নিজেই নিজের ছবি আকাঁর বিষয়বস্তু ও নাম করন সম্পর্কে বলেছেন—”ছবিতে নাম দেওয়া একেবারেই অসম্ভব। তার কারণ বলি, আমি কোনো বিষয় ভেবে আঁকিনি–দৈবক্রমে একটা কোনো অজ্ঞাত কুলশীল চেহারা চলতি কলমের মুখে খাড়া হয়ে ওঠে । “ কবির লেখনির রহস্যময়তার সাথে, ছবির রহস্যময়তার পার্থক্য হলো ঘুমিয়ে দেখা রাতের স্বপ্ন ও দিবাস্বপ্নের মতো, প্রথমটা যেমন রহস্যবৃত পরেরটা পরাবাস্তব। সবকিছু মিলিয়ে রবিন্দ্রনাথের প্রবর্তিত যে ধারা তা এমন এক অদ্ভুত সমন্বয় যে সেই ধারার আর কোনো অনুসারি গড়ে ওঠেনি।
রেখার মায়াজালে আমার সমস্ত মন জড়িয়ে পড়েছে (রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ) :
রবীন্দ্রনাথের ছবি আঁকার প্রধান মাধ্যম ছিলো কালি ও কলম। যেহেতু লিখতে লিখতে তিনি ছবি আকঁতে শুরু করেন, ইজেল, ক্যানভাস না , কালি কলমে কাগজের মিতালীতে সে অসাধারণ শিল্প সৃষ্টি হয়েছে তা বোধ করি আর কোনো মাধ্যমেই সম্ভব হতো না। জানা যায় তিনি লাঠির আগায় কাপড় বেধে তুলির মতো ব্যবহার করতেন। এছাড়াও তিনি জলরঙ, তেল ও মিশ্র মাধ্যম ব্যবহার করে কাজ করেছেন। সাধারনত হলুদ, লাল , বাদামী, সবুজ , ধূসর ও কালো, রঙের ব্যবহার বেশী দেখা যায় রবীন্দ্রনাথের কাজে। নন্দনতাত্ত্বিক গবেষনা এবং ফরাসী সাহিত্যিক রোমা রোলা’র কাছে করা রবীন্দ্রনাথের কিছু মন্তব্য থেকে ধারনা করা হয় রবীন্দ্রনাথের একধরনের কালার ব্লাইন্ডনেস ছিল, যাকে বলে প্রোটানোপিয়া বা আংশিক ভাবে কিছু রঙ শনাক্ত করার অক্ষমতা(রবীন্দ্রনাথের ক্ষেত্রে লাল)।
সমকালীন শিল্পবিষারদরা কবিগুরুর কৌশলকে রাশিয়ান অভিব্যাক্তিবাদ শিল্পী কান্দিনিস্কির সাথে তুলনা করেছেন , আবার তুলনা করেছেন সুইস-জার্মান শিল্পী পল ক্লির সঙ্গে। দ্বিমাত্রিকতার দিক থেকে আরেক ফরাসী শিল্পী অঁরি মাতিসের সাথেও তুলনা করেন কেউ কেউ অথবা নরওয়ের প্রতীকবাদ শিল্পী এডওয়ার্ড মুন্কের সাথে। তবে আমি বিশেষ করে মুন্কের সাথে মিল পাই, প্রয়োজনের তুলনায় লম্বা শরীর, বাদামী ও কালচে গাঢ় রঙের ব্যবহার আরো বেশী করে মনে করিয়ে দেয় ফরাসী প্রতীকবাদ শিল্পী অডিলঁ রেদোনে এর কাজ। আধ্যাত্মিকতাবাদী ইংরেজ কবি উইলিয়াম ব্লেক ও কালি কলমেই আকতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করতেন, তবে কবি গুরুর মতো এত বিমূর্ত নয়, উনি অনেক মূর্ত ছবি আঁকতেন বেশীর ভাগই আধ্যাত্মিকতাবাদ নিয়ে এবং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মতো পান্ডুলিপির ভাজে ভাজে ছবি আঁকা দেখে লেবানিজ কবি কাহলিল জিব্রানের কথা মনে হতে পারে।

একেলা আমি বাহির হলেম তোমার অভিসারে, সাথে সাথে কে চলে মোর নিরব আন্ধকারে (রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ) :
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ১৯২৮ প্রথম প্রদশর্নী অনুষ্ঠিত হয় শান্তি নিকেতনে, এর পরে কোলকাতায়, লক্ষৌ, বোম্বাই, সিংহল (বর্তমানে শ্রীলংকা), ইউরোপের বিভিন্ন দেশে যেমন জামার্ন, ফ্রান্স , ইংল্যান্ড, ডেনমার্ক, রাশিয়া এমনকি আমেরিকাতেও প্রদর্শনী হয়েছে তার। এর মধ্যে বেশ কয়েকবার প্রদর্শনী করেছেন ইংল্যান্ড এর লন্ডন সহ বিভিন্ন স্হানে বা শহরে। বোধ করি, সেই সময় কোনো প্রতিষ্ঠিত শিল্পীরও এতগুলো প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়নি বিদেশের মাটিতে ।
সেই সময় উপমহাদেশের শিল্পকলায় আধুনিক সময়ের প্রয়োজনিয়তাকে অনুধাবনের ক্ষেত্রে যেমন, বেঙ্গল স্কুলের আবদানকে অগ্রবর্তী মানতে হয় বা বেঙ্গল স্কুলের ভুমিকাকে avant garde বলা যেতে পারে, তেমন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রধান ভূমিকা কে ও অস্বীকার করবার কোনো উপায় নেই ।
রবীন্দ্রনাথ নিজেই বলেছেন ছবির আমি ও লেখার আমি ভিন্ন । কবি শঙ্খ ঘোষের ভাষায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ক্রমাগম বিবর্তন ‘আত্মগত আমি’ থেকে ’বিশ্বগত আমি’ তে ধাবিত। শঙ্খ ঘোষ শুধুমাত্র সাহিত্যের ক্ষেত্রে তাঁর মূল্যবান বিশ্লেষন প্রকাশ করলেও ছবির রবিও ত্রুমাগত বিশ্বজনিনতায় নিজেকে ছড়িয়ে দিয়েছিলেন আলোক রশ্নির মতোই। চিত্রশিল্পী ভ্যান গোর মতো তিনি ও জীবনের শেষ দশটা বছর একটানা ছবি এঁকে গেছেন, জীবদ্দশায় অনেক প্রদর্শনী করলেও সমকালীন তথাকথিত প্রথাগত শিল্পী সমাজ তাকে শিল্পী হিসেবে মেনে নিতে পারেনি। প্রদাপাদিত্য পালের সম্পাদিত রবীন্দ্রনাথের একটি জীবনীগ্রন্থ অনুযায়ী,রবীন্দ্রনাথের আক্ষেপ ছিল, তার নিজের দেশের মানুষ তার আঁকাকে মুল্যায়ন করতে পারেনি। এবং তার সমসাময়িক শিল্পীরা রবীন্দ্রনাথের আকার ব্যাপারে তার কোন প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা না থাকার ব্যাপরটায় বেশী গুরুত্ব দিয়েছিল।
এমনকি কবিগুরু মৃত্যুর আজ ৭০ বছর হতে পরেও আমরা রবীন্দ্রনাথের শিল্পকর্মগুলোর যতার্থ মযার্দা দিতে পারিনি । আমরা জানিও না যে আমাদের এই উপমহাদেশের শিল্পকলার ইতিহাসে, আধুনিক শিল্পের প্রধান চরিত্র আর কেও না আমাদের কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তাঁর হাতেই হাজার বছরের ঐতিহ্যধারী উপমহাদেশের ধ্রুপদী শিল্পকলা আধুনিকতার আকার পেয়েছে । আমরা অত্যন্ত গর্বের সাথে বলতে পারি এই উপমহাদেশের শিল্পকলায় আধুনিক ধারা প্রবর্তন করেন দুই বাঙালী শিল্পী প্রথমে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, পরবর্তিতে শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীন।
২০০০ সালের ৩১ ডিসেম্বর, আনন্দবাজার পত্রিকার সম্পাদকীয়তে লেখা হয়: আজ রাত্রি বারোটায় খৃষ্টীয় ২০০০ অব্দের অবসান ঘটিবে। অবসান ঘটিবে বিংশ শতাব্দীর । …বিংশ শতাব্দীর বাঙালী বিশুদ্ধ জ্ঞানচর্চার প্রতি যথেষ্ট অনুরাগ দেখায় নাই। বস্তুত কি বিদ্যা চর্চায়, কি সংস্কৃতিচর্চায় সর্বক্ষেত্রেই বাঙালী সহজে রস গ্রহন করা যায়, তাহারই সমাদর করিয়াছে। দুরূহ শিক্ষিত, মননবদ্ধ, সংস্কৃতির গভীরে আবগাহনের ধীশক্তি ও ধৈর্য বঙ্গীয় সমাজে বিরল । তাহার শেষ্ঠ প্রমাণ বাঙালীর রবীন্দ্রনাথ প্রীতি । তাঁহাকে লইয়া বাঙালীর উৎসাহ উদ্দীপনা অসীম, কিন্তু তাঁহার সৃষ্টির যে সীমিত অংশে যথার্থ গভীরতা আছে, তাহার প্রতি বাঙালী বিমুখ । তাঁহার আঁকা ছবি নি:সন্দেহে তাঁহার শেষ্ঠ সৃষ্টি, বাঙালী তাহা দেখিয়াও দেখে নাই ।
যদিও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের চিত্রকলা বেশীর ভাগই গভীর, গাঢ়, মধুর আঁধারে আচ্ছন্ন। আমি বলবো সে আঁধার আলো হয়ে এসেছিলো আমাদের শিল্পকলার জগৎকে আপন আলোকে আলোকিত করতে।
সম্পাদনা: কাজী মাহবুব হাসান
“কতবার ভেবেছিনু আপনা ভুলিয়া
তোমার চরণে দিব হৃদয় খুলিয়া।
চরণে ধরিয়া তব কহিব প্রকাশি
গোপনে তোমারে, সখা, কত ভালোবাসি।”
রবি ঠাকুর কে নতুন ভাবে চিনলাম…
LikeLike
🙂 Thanks for reading
LikeLike
Really made me more curious about the classic creator Rabindranath Tagore. The information provided in this article is new to me.
Thanks for sharing.
LikeLike
ধন্যবাদ আপনাকেও
LikeLike