
“আশাকরি মৃত্যুটা আনন্দের হবে, আমি আর কখনোই ফিরে আসার প্রত্যাশা করিনা’’ মৃত্যু যন্ত্রনা কাতর শিল্পী ফ্রিদা কাহলোর উক্ত উক্তি থেকেই অনুমেয় যে, তিনি জীবনের যে প্রবাহিত স্রোতের সঙ্গী ছিলেন, সুস্হ স্বাভাবিক জীবন যাপনকারী যে কোনো মানুষের পক্ষে সেটা উপলব্ধি করা অনেকটাই দু:সাধ্য ব্যপার।
প্রকৃতি ও জীবন দ্বারা সুর্নিদিষ্ট বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতার প্রাচীর পেরিয়ে নারীদের শিল্পকলার চর্চার ইতিহাস বহু প্রাচীন হলেও, শিল্পী হিসেবে প্রতিষ্ঠা পাওয়ার সামনে ছিলো নানা ধরনের সুসংবদ্ধ প্রতিকুলতা। শিল্পকলার ইতিহাসে শিল্পী হিসেবে নারীদের অবস্হান অতটা দৃঢ় না হলেও, যুগে যুগে নারীরাও শিল্প চর্চা করে এসছেন আপন উৎসাহে। বিশেষ করে বিংশ শতাব্দীতে এসে নারীদের আপন ভাব প্রকাশের মাধ্যম হিসেবে শিল্প কলার ব্যবহার বেড়ে যায় বহুগুনে। ক্রমাগত শিল্পকলার চর্চা ও স্বতর্স্ফুত অংশগ্রহনের মাধ্যমে নারী শিল্পীরাও করে নিয়েছেন এক বিশেষ অবস্হান শিল্পকলার জগতে। শিল্পকলার ইতিহাসের সেই বিশাল জগতে অনান্য অনেক নারী শিল্পীদের মাঝে যে নামগুলো প্রথম সারির তিরিশ জন শিল্পীর মধ্যে উঠে আসে, তা হলো মেক্সিকান চিত্রশিল্পী ফ্রিদা কাহলো। এমনকি ভ্যান গগ, মদিগ্লিয়ানি, দালি বা অন্য আরো অনেকের মতো প্রথম কয়েকজন জনপ্রিয় মাস্টার আর্টিস্টদের নামের সমান্তরালে আজ দেখা যায় এই স্বশিক্ষিত, শিল্পীর নামটিকেও।
ফ্রিদা কাহলোর জীবনকে যদি একটা যাদুঘর ভাবা যায়, এবং সেই যাদুঘরে যদি আমরা ঘুরে আসি একবার, তাহলে দেখবো যে, জীবন কত স্বেচ্ছাচারী হতে পারে, নিয়তি হতে পারে কত নির্দয় ও নিষ্ঠুর। জীবন মানুষকে সেটাই দেয় যা সে দিতে চায় অথবা জীবন যাপনকারী চেয়ে নেয়? নাকি মানুষ নিজেই নিজের ভাগ্যবিধাতা, অথবা নিয়তি মানুষের গন্তব্যের নির্ধারক? এই সব প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হতেই, সীমাহীন যন্ত্রনা ও একের পর এক ঘটে যাওয়া ঘটনা ও র্দূঘটনা, শারীরিক ও মানসিক বিপর্যস্ততা, ফ্রিদা কাহলোর জীবনকে করে তুলেছিলো দু:স্বপ্নের থেকেও ভয়াবহ, বাস্তবতার চেয়েও বাস্তব। সেই দু:স্বপ্নের হাত থেকে বাঁচতে প্রতিনিয়ত মানুষ খোঁজে আশ্রয়, আর একজন ভাগ্যাহত মানুষকে শ্রেষ্ঠতম সান্ত্বনার আশ্রয় যে দিতে পারে, তা হলো শিল্পকলার সীমাহীন ছায়াতল।
১৯০৭ সালের ৬ই জুলাই মেক্সিকোতে জন্ম গ্রহনকারী সেই অসীম সাহসী শিল্পীও শিল্পের ছত্রছায়ায় এক পরাবাস্তব বাগানে, খুঁজে নিয়েছিলো তাঁর প্রশান্তির আশ্রয়। (যদিও জন্ম নিবন্ধনে আছে ফ্রিদা কাহলোর জন্ম, ৬ জুলাই ১৯০৭ কিন্তু ফ্রিদা কাহলো নিজের জন্ম তারিখ ৭ জুলাই ১৯১০ দিতে পছন্দ করতেন কারণ মেক্সিকান রেভ্যুলিউশন এই সালেই ঘটে) মাত্র আঠারো বছর বয়সে ঘটে যাওয়া মারাত্মক সড়ক দূর্ঘটনা থেকে অলৌকিক ভাবে বেঁচে গেলেও আজীবন তাঁকে ভূগতে হয়েছে দূর্বিসহ শারীরিক ও মানসিক যন্ত্রনায়। আরো আগে মাত্র ছয় বছর বয়স থেকে ফ্রিদা এক পায়ে পলিওতে ভোগেন। সেই ভোগান্তির সাথে যুক্ত হয় সড়ক দূর্ঘটনার যন্ত্রনা। মারাত্মক ভাবে আঘাতপ্রাপ্ত হয় তাঁর মেরুদন্ড। লোহার রডে এফোড় ওফোড় হয়ে যায় তাঁর কোমল কিশোরী দেহ। ছিন্নভিন্ন করে দেয় সদ্য বেড়ে ওঠা নারী শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ গুলো। একের পর এক অস্ত্রপচার, সর্বোমোট ৩০ বার বা তারো বেশী, শিল্পী ফ্রিদাকে যেমন দিয়েছে জীবনের প্রতি বিতৃষ্ণা তেমনি আবার করেছে শিল্পের প্রতি মোহোবিষ্ট।
নাহ, শেষ হয়নি একোনো এক জীবনে দু;স্বপ্নের রাত। সন্তান ধারণ করা তাঁর পক্ষে প্রায় অসম্ভব জেনেও, তিন বারের বেশী সন্তান ধারণের চেষ্টায় ব্যর্থ হয়েছেন, সহ্য করেছেন গর্ভপাতের তীব্র যন্ত্রনা। সে সমস্ত শারীরিক যন্ত্রনা ও পরর্বতী জীবনে স্বামী রিভেরার কাছ থেকে প্রাপ্ত মানসিক আঘাত, ফ্রিদাকে সামগ্রিক ভাবে ভেঙ্গে ফেললেও র্দূবল করে দিতে পারেনি এক মুহূর্তের জন্যও। ফ্রিদা কাহলোর ভাষায় যদিও তাঁর জীবনের মারাত্মক দূর্ঘটনা মাত্র দুটো, এক; সড়ক দূর্ঘটনা, দুই; তাঁর স্বামী রিভেরা। ফ্রিদার মাত্র ৪৭ বছরের স্বল্পদীর্ঘ জীবনের এই র্দূঘটনাগুলো, শুধু দুষ্টু গ্রহের মতই কাজ করেনি, তাকে করেছে আরো সাহসী ও মানসিকভাবে দৃঢ়। মৃত্যু তাঁর অবধারিত জেনেও প্রতিনিয়ত লড়ে গেছেন নিয়তির সাথে। তাই শিল্পী ফ্রিদা কাহলো কে ‘সংশপ্তক’ বলা যায় র্নিদ্বিধায়!
প্রখ্যাত শিল্পী ভ্যান গো এর মতো ফ্রিদা কাহলোও শিল্পকলার জগতে আরো একজন স্বশিক্ষিত শিল্পী। যার শিল্পী জীবনের শুরু থেকে শেষ অবধি আত্মপ্রতিকৃতিই এঁকেছেন এবং শিল্পী দৃঢ়চিত্তে ব্যক্ত করেছেন যে তিনি সবচেয়ে বেশী নিজেকেই জানেন, তাঁর শিল্পকর্মের বিষয়বস্তু তাই আত্মউপলব্ধির ও আত্মঅনুভবের বর্ননামালা। ফ্রিদা কাহলোর শিল্পকর্ম মূলত তাঁর নাতিদীর্ঘ জীবনের যন্ত্রনার মহাকাব্য। ভূদৃশ্যের সাথে সঙ্গমে করা তাঁর আত্মপ্রতিকৃতি ও জড় জীবন সব কিছুই যেন বর্ননা করে নির্বাক ভাষায় তারঁ জীবনের নানা গল্প। পাওয়া না পওয়ার কাব্য গাঁথা আর ভালোবাসা-সম্পর্ক-জীবনযুদ্ধের দ্বন্দময় মিশ্রনের নান্দনিক নৈশব্দিক উপাখ্যান যেনো।

ফ্রিদা কাহলোর জীবনের ঘটে যাওয়া ঘটনা ও র্দূঘটনার অপূর্ব সঙ্গমে সৃষ্টি তাঁর সন্তান তুল্য সৃষ্টিকর্ম। মেনারিজমের মত লম্বা গলায় আঁকা প্রতিকৃতি সহ, লক্ষ করা যায় বিভিন্ন মেক্সিকান লোকজ শিল্পের ও প্রিকলোম্বিয়ান সংস্কৃতির প্রভাব। আর পরাবাস্তবের সত্যিকার অর্থে পরিস্ফূটন যদি ঘটে থাকে, কোনে শিল্পীর কাজের পরিসরে, তা একমাত্র ফ্রিদা কাহলোর। যেখানে তাঁর নিজের জীবনই ছিলো এক দু:স্বপ্নের মতো। সুইস শিল্পী আলবার্টো জিওকোমিত্তির কথায় ভিত্তি করে বলা হয়, পরাবাস্তববাদীতা আসলে অতিবাস্তব কোনো ঘটনার অভিব্যক্তি। যেমন ফ্রিদা বিক্ষোভের স্বরে বলেছিলেন যে তিনি কোনো পরাবাস্তববাদী শিল্পী না, তিনি স্বপ্ন আঁকেন না, তিনি তাঁর জীবনের অতিবাস্তব ঘটনা গুলোই আঁকেন।
শিল্পী হওয়াই ছিলো তার নিয়তির লেখন যেনো। প্যারামেডিকেলের শিক্ষার্থী ছিলেন ফ্রিদা কাহলো। ভবিষ্যতে চিকিৎসক হবেন এমন স্বপ্নকেও জলান্জলি দিতে হলো। তাইতো হাসপাতালের বিছনায় শুয়ে ফ্রিদা বলেছিলেন, “আমি অনুভব করছি আমার এখোনো অনেক শক্তি আছে কিছু করার; কিন্ত লেখাপড়া করে চিকিৎসক হওয়ার মতো এত শক্তি নেই, আর কিছু না ভেবেই আমি আঁকতে শুরু করি ….” ।
তারপরেও আমরা জানি শিল্পী ফ্রিদা ছিলেন পরাবাস্তবাগানের সেই দূর্লভ ক্যাকটাস ফুল, যা কেবল মেক্সিকোর পরাবাস্তব ভূদৃশ্যেই ফোটা সম্ভব। ফরাসী শিল্প সমালোচক ও লেখক আঁন্দ্রে ব্রেতোঁ এক কথায় ফ্রিদাকে বনর্না করেছিলেন : ফিতায় মোড়া বোম্ব হিসেবে।
পরাবাস্তববাদী শিল্পী ফ্রিদা কাহলোর কাজের সাথে আমার প্রথম পরিচয় ঘটে ছাত্র জীবনে। যদিও তিনি কোনো ভাবেই স্বীকার করতে নারাজ যে তিনি পরাবাস্তববাদী বৃত্তের একজন ছিলেন। বিস্ময়ের কথা হলো, আমি ফ্রিদা কাহলো কে জানবার আগেই, নিজের অজান্তেই ফ্রিদার মত করে কাজ করতে আরম্ভ করেছিলাম । হয়তো আমাদের জীবনের অভিজ্ঞতাগুলোর কোনো সাদৃশ্য রয়েছে। সেই ফ্রিদাকে শিল্পকলার ইতিহাসের বইয়ের পাতায় দেখেছি আর দেখেছি তাঁর জীবন কাহিনী নিয়ে নির্মিত হলিউডের ফিল্ম ‘ফ্রিদা’ তে। ফ্রিদার উপরে নির্মীত সমস্ত প্রমান্যচিত্রও দেখে ফেলি এক সময় এক এক করে। এরপরে লন্ডনের ন্যাশনাল পোট্রেট গ্যালারীতে প্রথম দেখি ফ্রিদা কাহলোর প্রতিকৃতি নিয়ে আলোকচিত্রের প্রদর্শনী। প্রখ্যাত আলোকচিত্রী নিকোলাস মারে সহ সমসাময়িক বেশকিছু খ্যাতনামা আলোকচিত্রীর তোলা ফ্রিদার প্রতিকৃতি নিয়ে সাজানো ছিলো সেই বিশেষ প্রদর্শনী।

কিন্তু কখনো ভাবিনি সমগ্র ফ্রিদা কাহলোকে দেখতে পাবো এক সঙ্গে। ফ্রিদা কাহলোর মৃত্যুর অর্ধশতক পরে লন্ডনের টেট মর্ডান গ্যালারীতে আয়োজিত হলো তাঁর একক চিত্র প্রর্দশনীর। যা তাঁর জীব্দশায় সম্ভব হয়নি নানা কারনে, উদ্যোগ গ্রহনকরা সত্ত্বেও। ২০০৫ এর পুরো গ্রীষ্ম জুড়ে, থেমসের পাড়ে টেট মর্ডান গ্যালারীতে, উপচে পড়া দর্শকের ভীড় নিয়ে বয়ে চললো ফ্রিদা কাহলোর প্রদশর্নী। টেট মর্ডানে সদস্য হওয়ায় আমি বেশ কয়েকবার ফ্রিদা কাহলোর প্রদর্শনী দেখতে যাই মনের খোরাক মেটাতে। এমন অসাধারণ শিল্পীর কাজকে চোখের সামনে দেখতে পাওয়া বিশেষ ভাগ্যের ব্যাপারতো বটেই। উপরন্তু টেট মর্ডানের পেশাদারী কিউরেশন ও জাকজমকপূর্ন বর্হিসজ্জার কারণে প্রদর্শনীটি শিল্পকলার ইতিহাসে এক মাইল ফলক হয়ে থাকবে। সেই অভিজ্ঞতাকে আমি আমার শিল্পী জীবনের অনুপ্রেরণার উৎস করে রাখতে পেরেছিলাম।
টেট মর্ডানের সেই প্রদশর্নীতে শিল্পী ফ্রিদা কাহলোর আঁকা অধিকাংশ চিত্রকর্মই স্হান পেয়েছিলো। যেগুলোর মধ্যে প্রধানত আত্মপ্রতিকৃতিই বেশী। এছাড়াও ছিলো শিল্পীর জীবনের শেষ দিনগুলোতে আঁকা জড়জীবনের সিরিজ। ১৯৪২ সাল থেকে শিল্পী যে ডায়েরী লিখতে শুরু করেন, সেই ডায়েরীর বা স্কেচ বুকের পাতা থেকে নেয়া বিশেষ বিশেষ ড্রইং। ভূদৃশ্যসহ অবয়বধর্মী কাজ, আরো অনান্য চিত্রকর্মও শোভা পাচ্ছিলো। যেগুলোর বেশীর ভাগই তেল রঙে আঁকা, এছাড়া পেন্সিল, কালি কলম ও জল রঙের ব্যবহার করেছেন শিল্পী তাঁর অব্যক্ত ভাষাকে ব্যক্ত করতে। এই প্রদর্শনীটি ছিলো ফ্রিদার জীবনের ৩য় একক প্রদর্শনী। প্রথম প্রদর্শনীটি অনুষ্ঠিত হয় ১৯৩৮ সালে, নিউ ইয়র্ক শহরের জুলিয়ন লেভি গ্যালারীতে। শিল্প সমালোচক আঁন্দ্রে ব্রেতোঁর সহযোগিতায় ফ্রিদা কাহলোর, সেই প্রদর্শনীটি সামগ্রিক ভাবে অত্যন্ত সফলতা পায়। ঠিক পরের বছরেই ফ্রিদা কাহলো প্যারিসে, আয়োজিত পরাবাস্তববাদী শিল্পীদের প্রর্দশনীতে অংশগ্রহন করেন। কিন্তু প্রদর্শনীটি তেমন ভাবে সফলতা না পাওয়ায় ফ্রিদা মর্মাহত হন। ১৯৫৩ সালে, ফ্রিদা কাহলোর মৃত্যুর ঠিক আগের বছরে, প্রথমবারের মত স্বদেশ মেক্সিকোতে আয়োজিত হয় শিল্পীর প্রথম একক চিত্র প্রদর্শনী।
শিল্পী ফ্রিদা কাহলোকে অনেক দিক থেকেই আভোঁ গার্ড শিল্পী বলে অখ্যায়িত করা যায়। সেই সমসাময়িক সময়ের পরাবাস্তববাদের ঢেউ এসে তাঁর গায়ে লাগবার আগেই তিনে ছিলেন সেই ঢেউয়ের গায়ে লাগা প্রথম বাতাস। যার শিল্পকর্ম নয় গোটা জীবনই ছিলো পরাবাস্তববাদের মত, স্বপ্ন ও দু:স্বপ্নের মাঝে আটকে থাকা কোনো ক্যাকটাসের বাগান। ফ্রিদা কাহলোই প্রথম মেক্সিকান শিল্পী যার শিল্পকর্ম স্হান পায় প্যারিসের ল্যুভ মিউজিয়ামে। এমনকি প্যারিসের বিখ্যাত ফ্যাশন ম্যাগাজিন ভোগের প্রচ্ছদে স্হান পায় ফ্রিদা কাহলোর নিজের প্রতিকৃতি। তাঁর মেক্সিকান সাজসজ্জায় আধুনিক ও নান্দনিক ছোঁয়ার কারণে। এখানেই শেষ নয় শিল্পী ফ্রিদার প্রতিভাময় ব্যক্তিত্বের। তিনি শিল্পী স্বামী রিভেরার দেয়াল চিত্রের মডেল হয়েছিলেন বেশ কয়েকবার। তার বর্নাঢ্য জীবনে তিনি মেক্সিকোর রাজনীতি ও সমসাময়িক শিল্প ও সংস্কৃতিতে ছিলেন সক্রিয়। বিশেষ রাজনৈতিক ও সংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বদের সঙ্গে ছিলো ফ্রিদার হৃদ্যতা: যেমন রুশ বিপ্লবী লিওন ট্রটস্কি, আলোকচিত্রী নিকোলাস মারে, চিত্রশিল্পী জরজিও ও’কিফ এবং আরো অনেকে।

মেক্সিকানরা মৃত্যুকে জীবনের খুব কাছে রাখতে ভালোবাসেন। ফ্রিদা কাহলো যখন শারীরিক ভাবে বেশ অচল হয়ে পড়লেন তখন তিনি ক্রমাগত জড়জীবন নিয়ে কাজ করলেন । জীবনের সুধা, রঙ, রূপ, গন্ধ বোঝাতে ব্যবহার করলেন রঙ বেরঙের ট্রপিক্যাল ফলমূল ও সবজী। জীবনের প্রান প্রচুর্যের পাশে ছোট্ট একটা খেলনা কংকাল দিয়ে বুঝিয়ে দিলেন মৃত্যুই শেষ পর্যন্ত প্রতীক্ষা করে আছে সবার জন্য। আর মৃত্যু মানে তো আবার এক নতুন জন্ম মেক্সিকানদের বিশ্বাসে। কিন্তু ফ্রিদা একজীবনে দেখে নিলেন অনেক আর ফিরতে রাজী না তিনি। শিল্পী ভ্যান গো তাঁর ভাই থিওকে লিখেছিলেন ‘দীর্ঘ জীবন যেনো হেটে পার করার মতোই’। ফ্রিদারও ছিলো ভ্যান গো এর মত স্বল্প আয়ু।
শিল্পীর পৈত্রিক বাড়ী ‘ব্লু হাউসে’ তাঁর জন্ম, এমনকি এই বাড়ীতেই তাঁর মৃত্যু ঘটে । ১৯৫৪ সালের ১৩ জুলাই ঠিক জন্মদিনের সপ্তাহ পরে। বেশ বিরল একটা ঘটনা মানুষের জীবনে, সেটা ঘটে ছিলো ফ্রিদা কাহলোর ঘটনা বহুল জীবনে। সেই একই বাড়ীতে ফ্রিদা ঘর বাঁধেন স্বামী দিয়েগো রিভেরার সাথে, এক সঙ্গে কাটান দীর্ঘ পঁচিশ বছর। অনেক ঐতিহাসিক ঘটনার সাক্ষী এই বাড়ী। ১৯৫৭ সালে মারা যান শিল্পী দিয়েগো রিভেরাও। ১৯৫৮ সালে স্বামী দিয়েগো রিভেরার ইচ্ছায় ব্ল হাউসকে পরিনত করা হয় ফ্রিদার কাহলো মিউজিয়ামে। মেক্সিকো জাতির প্রিয় শিল্পীর কাজ দেখবার জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া হয় ‘ব্লু হাউসে’র দরজা ।
শিল্পী স্বত্তায় দূরদৃষ্টিতা যেনো অনেক খানি মিশে থাকে। যেমন ফ্রিদা কাহলোর মৃত্যুর মাত্র চার বছর আগে, ১৯৫০ সালে, স্ত্রী ফ্রিদাকে নিয়ে করা রিভেরার ভবিষ্যৎ বানী যে বৃথা যায়নি এক ফোটাও। আমরা আজ সময়ের সিঁড়িতে, ২০১১ এ দাড়িয়ে বুঝতে পারি- “ফ্রিদা হচ্ছে শিল্পকলার ইতিহাসে প্রথম নারী যিনি বলিষ্ঠ ও আপোষহীন সততার সাথে, এমনকি বলা যেতে পারে একধরনের নির্বিকার ও নিষ্ঠুরতার সাথে, এমন সব সর্বজনীন আর সুনির্দিষ্ট বিষয়গুলোকে তার শিল্পকর্মের বিষয়বস্তুতে রুপান্তরিত করতে পেরেছিলেন,যা শুধুমাত্র নারীদেরকে নাড়া দেয়”।
শিল্পী হিসেবে ফ্রিদা কাহলো অনেক দিক থেকেই অনন্য। শিল্পকলার পরিমন্ডলে তিনিই একমাত্র শিল্পী যিনি তাঁর শিল্প চর্চার বিষয় বস্তু হিসেবে নিজের জীবনের ঘটনাকেই বেছে নিয়েছেন অত্যন্ত সুনির্দিষ্ট কারণে। নিজের গর্ভপাতের মত বেদনাদায়ক বিষয়কে ও উপস্হাপিত করেছেন সাহসিকতা ও নান্দনিকতার সাথে। শিল্পী ফ্রিদা কাহলোর কাজ যেমন আমাকে অনুপ্রানিত করে, ঠিক তেমনি শিল্পীর জীবনও আমাকে সাহস যোগায় শত শহস্র গুনে। আজ শিল্পীর মৃত্যুর ৫৭ বছর পরে আমরা তাঁকে শ্রদ্ধাভরে স্মরন করছি। প্রতি বছর এই দিনে, সবাই শিল্পী ফ্রিদা কাহলোকে স্মরন করবে আরো চক্র বৃদ্ধি হারে। শুধুই তাঁর শৈল্পিক গুনাবলীর জন্য নয় বরং তাঁর সংশপ্তক প্রকৃতির জন্যও, এতে কোনো সন্দেহ নেই।

জুলাই ২০১১, টরেন্টো